মাদক বেচাকেনার অভিযোগ
কুমিল্লা ও মুরাদনগর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১৩:২৩ পিএম
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫ ২২:০৫ পিএম
কুমিল্লার মুরাদনগরে মাদক বেচাকেনার অভিযোগে এক নারী ও তার দুই ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই নারীর আরেক মেয়ে। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে কড়ইবাড়ী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এলাকার লোকজন তাদের ওপর হামলা করেছে।
নিহতরা হলেনÑ কড়ইবাড়ী গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা আক্তার ওরফে রুবি (৫৩), তার ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৫)। এ ছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন রোকসানার আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (৩০)। তিনি মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রুবি ও তার পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক কারবার, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রুবির বিরুদ্ধে ৯টি মাদক মামলা ও একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। নিহত জোনাকির বিরুদ্ধে ৫টি, রাসেলের বিরুদ্ধে ৯টি এবং আহত রুমার বিরুদ্ধেও ২টি মামলা রয়েছে। নিহত জোনাকির স্বামী মনির হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে ১৫টি মামলা।
ঘটনার সূত্রপাত গত বুধবার স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষকের মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের পর। ছিনতাইয়ের সঙ্গে রুবির পরিবারের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে সালিশে অংশ নিলে রুবি তাদের ওপর চড়াও হন। বাচ্চু মিয়াকে মারধর করে রক্তাক্ত করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এরপর গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে রুবির বাড়িতে হামলা চালায় এবং পরিবারের চারজনকে ঘর থেকে বের করে পিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই রুবি, রাসেল ও জোনাকি মারা যান। এ সময় গুরুতর আহত অবস্থায় রুমা আক্তারকে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সাততলা ভবনের জানালাগুলোর কাচ ভাঙা, রক্তের দাগ ছড়িয়ে আছে এবং একটি মোটরসাইকেল ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। আশপাশে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা যায়।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘রুবির পরিবার দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা করে আসছিল। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে মামলা দিয়ে হয়রানি করত। আজকের গণপিটুনি এই দীর্ঘ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’
কড়ইবাড়ী এলাকায় আবু বকর বলেন, ‘আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী রুবির অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার লোকজন। তারা বাড়িতে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা এবং এলাকায় চুরি-ডাকাতি ছিনতাই করত। রুবি এবং তার ছেলেমেয়েরা এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮২টি মামলা দিয়েছে। মাদক ব্যবসা, চুরি-ছিনতাইয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করত এ পরিবার। তাই অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী তাদেরকে গণপিটুনি দিয়েছে।’
হিরাকাশি গ্রামের মো. জয়দল হোসেন (৭০) বলেন, রুবি খুবই ভয়ংকর। মাদক ব্যবসা, দেহ ব্যবসা, চুরি সকল অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল সে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সে মামলা দিয়ে হয়রানি করত। এ কাজে তার ছেলে, মেয়ে ও মেয়েদের জামাইরাও জড়িত।
অন্যদিকে নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার জানান, সালিশে বিরোধের সময় তার পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা হয়। শিশু সন্তানের হাতও ভেঙে দেওয়া হয়। ঘটনার দিন সকালে শতাধিক লোকজন ধারালো অস্ত্র ও বাঁশ নিয়ে বাড়িতে হামলা চালায় এবং স্বামী-শাশুড়ি-ননদকে হত্যা করে।
বাঙ্গুরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, গণপিটুনিতে রুবি আক্তার ও তার মেয়ে জোনাকি এবং ছেলে রাসেল ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকসহ অন্যান্য অপরাধে মামলা রয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, ‘নিহতদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আসকের উদ্বেগ
কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারেরর তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গণপিটুনি বা মব সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করে এ ঘটনার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, প্রাথমিক অভিযোগ বা সন্দেহের ভিত্তিতে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এভাবে কাউকে হত্যা করা কেবল আইনের শাসনের পরিপন্থিই নয়, এটি নাগরিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।