সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১০:০৭ এএম
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১১:৪৭ এএম
টাঙ্গুয়ার হাওর পার্শ্ববর্তী মাটিয়ান হাওরের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে হাউসবোট
কয়েক দফা নীতিমালা প্রণয়ন, প্রচারণা ও জরিমানার পরও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। বিশেষ করে বিলাসবহুল পর্যটকবাহী হাউসবোটগুলো নির্ধারিত নৌপথ না মেনে হাওরের মাঝ দিয়ে চলাচল করায় হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অস্থায়ী ফসল রক্ষা বাঁধ, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, জলজ উদ্ভিদ ও স্থানীয় কৃষিজমি। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি যেমনÑ জিপিএস ট্র্যাকিং চালু করা গেলে হাউসবোটগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। জেলা প্রশাসনও জানিয়েছে, একটি অ্যাপস তৈরির মাধ্যমে হাউসবোট পর্যবেক্ষণ শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এর কার্যকর বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, হাউসবোটগুলোর বড় আকারের প্রপেলার ঝাউ বনসহ অন্যান্য জলজ গাছপালা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে মাছ ও পাখির আবাসস্থলও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
মধ্যনগর উপজেলার চামরদানী গ্রামের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের স্থানীয় নৌকা একদিকে চলাচল করি। নির্ধারিত রোডের বাইরে চলাচল করি না। কারণ হাওরে ঝাউ বনের জন্য নৌকা চলে না। নৌকার ফ্যান (প্রপেলার) আটকে যায়। আর পর্যটকবাহী হাউসবোটগুলো নির্ধারিত রোড বা নদীপথে খুব কম চলাচল করে। বাঁধ একটু ভাঙা দেখলে সেদিকে হাওরে প্রবেশ করে। যেদিকে ইচ্ছে তারা যায়। কারণ তাদের হাউসবোটের ফ্যান বড় হওয়ায় ঝাউ বনে আটকায় না। এতে ধীরে ধীরে মাছ কমছে।
একই এলাকার বাসিন্দা মো. নুরআলম বলেন, হাওরে আগের মতো মাছ নেই। বাজারে গেলে শুধু পাঙাশ পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরে হাউসবোটের সংখ্যা বেড়েছে। এগুলো হাওরের যেদিকে মন চায় চলাচল করে। এতে আমাদের স্থানীয়দের ক্ষতি হচ্ছে।
তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মো. তৌফিক আহমেদ বলেন, হাওরের মাছ, পাখি, শেওলা, ঝাউসহ অন্যান্য উদ্ভিদ নিয়ে ইকোসিস্টেম রয়েছে। হাওরের মাঝ দিয়ে যখন বড় বড় হাউসবোট চলাচল করে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হয়। শুধু নীতিমালা প্রণয়ন করে মাঝেমধ্যে মনিটরিং নয়, এটি বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট জলযাত্রার ক্যাপ্টেন মো. রনি শেখ বলেন, সুন্দরবনে প্রায় ২০ বছর পর্যটন খাতে কাজ করেছি। ওখানে পর্যটক ও সংশ্লিষ্টদের যেরকম নীতিমালা মানতে হয় তার তুলনায় টাঙ্গুয়ার হাওরে তেমন নীতিমালা মানতে দেখিনি। হাওরে ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসতে দেখেছি। প্রশাসন নিষেধ করেছে, তবুও এটি বন্ধ হচ্ছে না। প্রশাসনের নীতিমালা না মানার কারণে হাওরের মাছ-পাখি কমছে। পানির নিচের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, হাউসবোটগুলো নীতিমালার তোয়াক্কা না করে যেদিক খুশি চলাফেরা করছে। এতে হাওরে মাছ কমে যাচ্ছে, বাঁধ ভাঙছে, জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে।
আইটি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি হাউসবোটে জিপিএস ট্র্যাকার সংযোজন এবং একটি মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করলে হাউসবোটের চলাচল সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নির্ধারিত রুটের বাইরে গেলে সেই তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনের কাছে পৌঁছাবে এবং জরিমানাও অটোমেটিকভাবে আরোপ করা যাবে।
আইটি এক্সপার্ট মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, ‘ট্র্যাকিং ডিভাইস ও অ্যাপসের মাধ্যমে হাউসবোটের চলাচল নজরে রাখা সম্ভব। এ প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করলে হাওর বাঁচানো সম্ভব হবে।’
জেলা প্রশাসনের (রুটিন দায়িত্বে) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে একটি অ্যাপ তৈরি করেছি, শিগগিরই সেটি চালু হবে। হাউসবোটে জিপিএস ট্র্যাকার সংযোগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। একই সঙ্গে হাউসবোট ছাড়ার আগে প্রতিনিধি পাঠিয়ে ময়লা-আবর্জনার বিষয় নিশ্চিত করা হবে।’
তিনি আরও জানান, হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় প্লাস্টিকজাত পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পর্যটকরা খেয়ে সেগুলো পানিতে ফেলে দেন। এজন্য এধরনের পণ্য বিক্রি পুরোপুরি নিষিধ করে দিয়েছি।