এম.আর. রাজ, মহাদেবপুর (নওগাঁ)
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫ ০৯:৩৫ এএম
ফাইল ফটো
ভরা মৌসুমে বেড়েই চলেছে চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। দেশের ধান ও চালের বড় মোকাম নওগাঁর মহাদেবপুরে আবারও বেড়েছে পণ্যটির দাম। প্রকারভেদে পাইকারি বাজারে বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা। খুচরায় তা দাঁড়িয়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। বাজারে সরবরাহের ঘাটতির কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে করপোরেট ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে প্রয়োজনমতো ধান পাচ্ছেন না স্থানীয় ছোট ও মাঝারি মিলাররা। ফলে বাজারের চাহিদামতো চাল সরবরাহ করতে পারছেন না তারা।
প্রাকৃতিক কারণে এবার ধান উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও চালের দাম এতটা বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। নতুন ধানের প্রভাব নেই চালের বাজারে। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর অভিযোগ ভোক্তাদের। সরবরাহ ঘাটতির কথা বলছেন ছোট ব্যবসায়ীরা।
বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ও মাঝারি মিলাররা। এ সময় মূলত ছোট মিলাররা বাজারে চাল সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু করপোরেট ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে তারা বাজারে প্রয়োজনমতো ধান পাচ্ছেন না।
মহাদেবপুর উপজেলার শালবাড়ি গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কৃষক। ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে আমাদের সংসারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে হয়। তাই কে করপোরেট ব্যবসায়ী আর কে স্থানীয় তা আমাদের জানার প্রয়োজন হয় না। যার কাছে পরিবহন সুবিধা ও দুই টাকা বেশি পাই, তাদের কাছেই আমরা ধান বিক্রি করি।’
কোনো প্রকার মূলধন ছাড়াই ধান ক্রয়ের ব্যবসা করছেন আবু হাসান। তিনি মূলত মৌসুমভিত্তিক ধানের ব্যবসা করে থাকেন। মিলারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করেন তা মিলগেটে পৌঁছে দেন। বড় বড় মিলাররা মৌসুমের শুরুতেই প্রতিটি গ্রামে ২-৩ জন করে প্রতিনিধি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। তারা মিলারদের টাকা নিয়ে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনে তাদের সংগ্রহশালায় পৌঁছে দেন।
মহাদেবপুর উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসিআই গ্রুপের শাখায় কর্মরত নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করে থাকি।’ এই ধান প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কিছুদিন রাখা হয়। এরপর চাল উৎপাদন করে প্যাকেটজাত করা হয় বলে তিনি জানান।
মিল মালিকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার বিঘাপ্রতি ৪ থেকে ৬ মণ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে বাজারে কিছুটা সরবরাহ কম এবং বড় বড় মিলাররা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মজুদ করার উদ্দেশ্যে ধান কিনছে। যার ফলে স্থানীয় ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের মিলাররা ধান কিনতে পারছেন না। ফলে চাল উৎপাদন করতে পারছেন না। যার কারণে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সপ্তাহ আগে বাড়া শুরু হয় চালের দাম।
উপজেলার সবচেয়ে বড় চালের মোকাম আখেরার মোড়ে চাল বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৪ টাকা বেড়ে জিরাশাইল ৬৮-৭০ টাকা, শুভলতা ৬০-৬২ টাকা, কাটারি ৭০-৭২, ব্রি আর-২৮ চাল ৬২-৬৪ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫৫-৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এক সপ্তাহ আগেও পাইকারিতে জিরাশাইল ৬৪-৬৬ টাকা, কাটারি ৬৬-৬৮, শুভলতা ৫৭-৫৮, ব্রি আর-২৮ চাল ৫৯-৬০ এবং স্বর্ণা-৫ চাল ৫৩-৫৪ টাকা করে কেজি বিক্রি হয়েছিল। বর্তমানে কেজি প্রতি ৫-৬ টাকা বেড়ে জিরাশাইল ৭০-৭২ টাকা, কাটারি ৭৫-৮০, শুভলতা ৬২-৬৪, ব্রি আর-২৮ চাল ৬৫-৬৬ এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা চাল ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের মিলাররা বেশি দামের কারণে চাহিদামতো ধান কিনতে না পারায় চাল উৎপাদন করতে পারছেন না। ফলে বাজারে চাল সরবরাহ কমে গেছে।
এ ব্যাপারে একাধিক ভোক্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ধান ও চাল কিনে রেখে ভবিষ্যতে মুনাফা করার সুযোগ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা।
খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা ফারুক হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুদ করার একটি চক্রান্ত করছেন। ভরা মৌসুমেও যদি এভাবে চালের দাম বৃদ্ধি পায় তবে আমাদের বাঁচার উপায় থাকবে না।’
উপজেলা চালকল মালিক গ্রুপের আহ্বায়ক শামসুল আলম বাচ্চু বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিঘাপ্রতি ৩ থেকে ৫ মণ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কম। ফলে চালকল মালিক এবং বড় বড় কোম্পানিগুলো সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে মজুদ করছেন। ছোট-মাঝারি মিলাররা পাল্লা দিতে পারছেন না।
শামসুল আলম আরও বলেন, বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ও মাঝারি মিলাররা। এ সময় মূলত ছোট মিলাররা বাজারে চাল সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু করপোরেট ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে তাদের প্রয়োজনমতো বাজারে ধান পাচ্ছেন না। ফলে বাজারের চাহিদামতো চাল সরবরাহ করতে পারছেন না তারা। সরকারের উচিত এখনই এসব বড় প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেওয়া। না হলে সামনে আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে চালের বাজার।
অবৈধ মজুদের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের সাথে কথা হলে তিনি জানান, কোনো মিলার যদি অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ করে বাজার অস্থিরতা সৃষ্টি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই লক্ষ্যেই জেলা প্রশাসন কাজ করছে। ইতোমধ্যে জেলায় কয়েকটি মিলগেটে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।