প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫ ২২:৪১ পিএম
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ তিন দফা দাবিতে কাস্টমস অফিসারদের সংগঠন ‘কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট এক্সিকিউটিভ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করছে।
গত শনিবার শুরু হওয়া এই কর্মসূচি রবিবার (২৯ জুন)ও অব্যাহত ছিল। ফলে দেশের সব বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে তৈরি হচ্ছে কন্টেইনার ও জাহাজজট। এ ছাড়া স্থলবন্দর এলাকাগুলোতে আটকা পড়েছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই কর্মসূচি চলবে। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ঠিক রাখতে দ্রুত এই সমস্যার সমাধানে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে মানববন্ধনও।
জাহাজ জটের কবলে পড়তে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর
আমদানি করা পণ্যভর্তি কন্টেইনার জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। এরপর জাহাজ থেকে খালাস করে সেটি রাখা হয় বন্দরের ইয়ার্ডে। এরপর শুল্কায়ন করে সেখান থেকে পণ্য খালাস নেন আমদানিকারকরা। কিন্তু এই খালাস প্রক্রিয়া কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে বন্দরে তৈরি হয় কন্টেইনারজট। যার প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতে। সময়মতো খালাস করতে না পারলে কারখানায় তৈরি হয় কাঁচামালের সংকট। বাজারে কমে যায় পণ্যের সরবরাহ। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিরাজ করে স্থবিরতা।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির কারণে ঠিক এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। দুদিন কাস্টমসের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে জাহাজ চলাচলে। বন্দরের অভ্যন্তরে তৈরি হচ্ছে কন্টেইনার জট। সহসায় এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এক-দুই দিন পর জাহাজ থেকে কন্টেইনার লোড-আনলোড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। অচল হয়ে পড়বে বন্দরের কার্যক্রম, বহির্নোঙরে বাড়বে জাহাজ জট।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে স্বাভাবিক সময়ে যেখানে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কন্টেইনার ডেলিভারি হতো। এখন সেটি নেমে এসেছে শূন্যে। কর্মবিরতির কারণে নতুন করে কোনো কন্টেইনার ডেলিভারি হয়নি। এর বিপরীতে জাহাজ থেকে কন্টেইনার খালাস স্বাভাবিক থাকায় বন্দরে বাড়তে শুরু করেছে জট।
গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল থেকে রবিবার সকাল) বন্দরে কন্টেইনার বেড়েছে ১ হাজার ৮৬০ টিইইউস। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি চলমান থাকলে আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে কন্টেইনারের এই জট ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসাইন চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কাস্টমসের কার্যক্রম দ্রুত শুরু না হলে নৌবাণিজ্যে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। ইতোমধ্যে জেটিতে জাহাজের গড় অবস্থান বাড়তে শুরু করেছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ইয়ার্ডে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউস। এই হিসাবে এখন বন্দরের অভ্যন্তরে রাখা যাবে ১১ হাজার ২০৩ টিইইউস কন্টেইনার। আগামী দুদিন ডেলিভারি না হলে এই সময়ের মধ্যে সেটি শেষ হয়ে যাবে। এরপর জাহাজ থেকে আর কন্টেইনার নামানোই যাবে না। তখন বন্দরের বহির্নোঙরে তৈরি হবে জাহাজ জট।
জানতে চাইলে বিকডার সচিব রহুল আমিন শিকদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে ডিপোতে কন্টেইনারের স্তূপ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের ১৯টি কন্টেইনার ডিপোর মোট ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৫ হাজার টিইইউস। সেখানে আজ (রবিবার) সব মিলিয়ে কন্টেইনার আছে ৮২ হাজার ৬৫৮ টিইইউস। কাস্টমসের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা পণ্যভর্তি কোনো কন্টেইনার বন্দরে পাঠাতে পারিনি। ঠিক একইভাবে আমদানি করা পণ্যভর্তি কোনো কন্টেইনার বন্দর থেকে ডিপোতেও আসেনি।
বন্দরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পোশাক রপ্তানিকারকরা। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা কর্মবিরতি পালন করায় আমরা বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে পারছি না। উৎপাদন লাইন অফ করে রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে সময়মতো কন্টেইনার খালাস করতে না পারায় বন্দরের চারগুণ ডেমারেজ চার্জ গুনতে হবে। কয়েকদিন পরপর এভাবে হলে তো আমরা ব্যবসা চালু রাখতে পারব না। আমাদের দাবিÑ দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। না হলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ।
অচলাবস্থায় স্থলবন্দরগুলো
কাস্টমস কর্মকর্তাদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে দুদিন ধরে দেশের সব স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে অচলাবস্থায় রয়েছে বেনাপোল, আখাউড়া, হিলি, সোনামসজিদ, বুড়িমারী ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্ধর।
এসব বন্দরের উভয় পাশে আটকা পড়েছে হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক। এসব ট্রাকে পচনশীল পণ্য থাকায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরের কাজের ওপর (লোড-আনলোড) নির্ভরশীল শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তবে সচল আছে পাসপোর্ট ও ভিসাধারী যাত্রী পারাপার। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী-শ্রমিকদের মানববন্ধন
কাস্টমসের কমপ্লিট শাটডাউনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পৌর মার্কেট চত্বরে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বক্তব্য দেন ইপিজেড ব্যবসায়ী মো. নাসির তালুকদার, বন্দর ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান মানিক, এমরান হোসেন ও শ্রমিক নেতা মো. আলাউদ্দিন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, কাস্টমসের কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ টু এনবিআরের নামে ধর্মঘট ও রাজস্ব আদায়ে বাধা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। যারা এসব কর্মসূচি পালন করছেন, তারা আওয়ামী লীগের দোসর। আওয়ামী লীগের আমলে চাকরি হওয়া ব্যক্তিরাই দেশকে অস্থিতিশীল ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে এ হীন কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
বক্তারা আরও বলেন, যারা আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন, তাদের চাকরিচ্যুত করে সেখানে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত বেকার যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তারা আরও বলেন, আন্দোলনরত কাস্টমস তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলে মোংলা কাস্টম হাউস ঘেরাও, মানববন্ধনসহ নানা ধরনের কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম, বেনাপোল, আখাউড়া, হিলি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও মোংলা প্রতিবেদক।