মধ্যাঞ্চলীয় অফিস
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫ ১৫:৩৮ পিএম
কবর খুঁড়তে যাওয়ার পথে নিজের ঘোড়াটি ছিল একমাত্র সঙ্গী। ফাইল ফটো
কারও মৃত্যুর সংবাদ কানে এলেই খুন্তি, কোদালসহ নানা সহায়ক যন্ত্রপাতি নিয়ে কবরস্থানে ছুটে যাওয়া কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা গোরখোদক মনু মিয়া ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শনিবার (২৮ জুন) সকাল ১০টা ২০ মিনিটে তার নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মনু মিয়া গত ১৪ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন।
এদিকে মনু মিয়ার মৃত্যুতে ফেইসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কেউ গোরখোদক মনু মিয়া লিখে শোক প্রকাশ করছেন, আবার কেউ নিজের সাথে তার স্মৃতির কথা তুলে শোকার্ত হচ্ছেন, অনেকে তার সান্নিধ্য হারানোর বেদনায় কাতর। সবাই প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করছেন তিনি যেন ওপারে ভালো থাকেন।
পরম যত্ন আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করতেন মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ আশ্রয়স্থল ‘কবর’। মানুষের শেষ বিদায়ের একান্ত সঙ্গী হয়ে সাদা কাপড় পরানো থেকে শুরু করে আতর-গোলাপ মাখিয়ে পাশে থাকতেন কবরে মাটি দেওয়া অবধি। হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় শেষ বিদায়ের এই পরম সঙ্গীর নাম এই ছিল গোরখোদক মনু মিয়া। গোর খুঁড়ে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বখশিস না নিয়ে এ পর্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর।
জানা যায়, দুই ভাই ও তিন বোনের সংসারে মনু মিয়া ছিলেন তৃতীয়। কবর খোঁড়ার কাজে বাহন হিসেবে এ পর্যন্ত তিনি চৌদ্দটি ঘোড়াও কিনেছেন। আর এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে তার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি। পৈত্রিক অন্য সম্পত্তি বন্ধক দিয়েই চলছিল নিঃসন্তান মনু মিয়ার সংসার ও কবর খোঁড়ার কাজ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কবর খোঁড়ার কাজ করতে খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাত ইত্যাদি ভর্তি বস্তাসহ হাওরের বন্ধুর পথে ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছে যেতেন তিনি। কবর খোঁড়ার সেই নিখুঁত কারিগর আজ তার নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার সুনাম রয়েছে দুর্গম হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পাশের এলাকায়। এ ছাড়া রাজধানীর বনানী কবরস্থানসহ দেশের নানা প্রান্তে তার সুনাম রয়েছে। শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হন না মনু মিয়া। এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন তিনি, তাঁদের মৃত্যুর দিন–তারিখ সব লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে।
শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মনু মিয়া গত ১৪ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সময় তার বাড়িতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। তিনদিন যাবৎ গ্রামবাসী কারো নজরে পড়েনি মনু মিয়ার ঘোড়াটি। পরে রাতের কোনো এক সময় রহস্যজনক কারণে দুর্বৃত্তরা মনু মিয়ার ঘোড়াটিকে পার্শ্ববর্তী মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের হাসিমপুর এলাকায় নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে রাস্তার পাশের ডোবায় ফেলে রাখে। প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে ঘোড়াটি। পরে সকালে হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের একটি মাদরাসার পাশের জমির পানির মধ্যে ঘোড়াটি লাশ পড়েছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান আলগাপাড়া গ্রামের তিন তরুণ-যুবক। তারা গিয়ে মৃত অশ্বের মুখ দেখে চমকে ওঠে পরে আশপাশের গ্রামের লোকজন। সকলেই চিৎকার করে বলে ওঠে ‘আরে এযে আমরার গোরখোদক মনু মিয়ার ঘোড়া’। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মনু মিয়া।
জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন ঠাকুর গোরখোদক মনু মিয়র মৃত্যুর বিষয়টি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে নিশ্চিত করে বলেন, ঘোড়ার মৃত্যুর পর থেকেই মনু মিয়া শারীরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে এলেও আর আগের মতো হয়ে ওঠেননি। তার মৃত্যুতে আমরা একজন দয়ার সাগর, নিঃস্বার্থ মানুষকে হারালাম। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।