রাঙামাটি
রাঙামাটি সংবাদদাতা
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ১৭:৩৭ পিএম
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫ ১৭:৪৬ পিএম
‘আমাদের তো জায়গাজমি নাই, আমরা অসহায় বলেই পাহাড়ের নিচে বসবাস করি’Ñ এভাবেই নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানান রাঙামাটির দিনমজুর হোসেন আলী। ১০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন তিনি। বিকল্প জমি না থাকায় তার মতো অনেক পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতেই ঠাঁই নিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত বন উজাড়, পরিবেশবিনাশী বনায়ন ও নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি ধসের আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী বর্ষায় বৃষ্টিপাত বেশি হলে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা তীব্রতর হবে। তবু রাঙামাটিতে কয়েক হাজার পরিবার এখনও পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
ষাটের দশকে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর থেকেই পাহাড়ে বসতির প্রবণতা শুরু হয়, যার জেরে শুরু হয় পাহাড় ও বন উজাড়। এতে বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। গত এক দশকে পার্বত্য এলাকায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৭ সালের পাহাড়ধসÑ প্রাণ হারায় ১২০ জন। এরপর ২০১৮ সালে মারা যায় ১১ জন এবং পরবর্তী বছর কাপ্তাইয়ে প্রাণ হারায় আরও তিনজন। দিন যত যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকির পরিমাণ তত বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, মানুষের বসবাসের কারণে পাহাড়ের গায়ে থাকা গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছে পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ বন্ধন। ফলে বর্ষাকালে পাহাড়ধস এখন নিয়মিত দুর্যোগে রূপ নিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড় কাটার পেছনে দখলদারদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পেও নিয়ম না মেনে পাহাড় কাটা হয়। আর বন উজাড়ের কারণেও পাহাড় হারাচ্ছে প্রাকৃতিক প্রতিরোধশক্তি।
রাঙামাটির শিমুলতলি, রূপনগর, পুরাতন পুলিশ লাইন, যুব উন্নয়ন এলাকা ও রাঙ্গাপানি এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। ২০১৭ সালের ১৩ জুন এসব এলাকাতেই ঘটে ভয়াবহ পাহাড়ধস, এতে ৫ সেনা সদস্যসহ প্রাণ হারায় ১২০ জন। ধসে পড়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় অংশ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একাধিক সড়ক।
ঝুঁকিতে বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় থাকতে হলে সমতল ভূমি কোথায় পাব। আমাদের তো অন্য কোনো জায়গা নাই। তাই নিরুপায় হয়ে এখানেই বসবাস করি। বেশি সমস্যা হলে তখন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে।’
রূপনগরের বাসিন্দা সোমেলা আক্তার বলেন, ‘২০১৭ সালের ঘটনা মনে হলে এখনও ভয় লাগে। আমাদের পাশের পরিবারের সবাই মারা যায়। মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
একই এলাকার শাহনাজ বেগমের কথায়, ‘আমরা গরিব বলেই পাহাড়ে থাকি। বৃষ্টি হলে ভয় পাই, কিন্তু যাওয়ার জায়গা নেই। সরকার যদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে, তাহলে যাব।’
রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, ‘২০১৭ সালের পর যেসব পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতেই এখনও শুধু মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ হয়নি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সাধারণ সম্পাদক জিসান বখতেয়ার বলেন, ‘পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করে স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।’
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুপ্রিয় চাকমা বলেন, ‘আমাদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই। সবকিছু শহরের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে, ফলে চাপ বাড়ছে এবং পাহাড়ি এলাকা দখল হচ্ছে। বর্ষাকাল এলে মাইকিং করে সমাধান সম্ভব নয়, দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা।’
গত ২২-২৯ মে ভারী বৃষ্টিপাতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের ঘটনা ঘটেছে। বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে মৌসুমজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি অব্যাহত আছে।
রাঙামাটির স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, ভূমিক্ষয় পার্বত্য এলাকার জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জানমালের জন্য বড় হুমকি। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া জটিল হলেও তা এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখনকার লক্ষ্য হচ্ছে বর্ষায় মানুষের প্রাণ যেন হুমকির মুখে না পড়ে, সেজন্যই আমরা কাজ করছি।