সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ০৯:১২ এএম
চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে কাঁচা ও আধাপাকা ঘর এবং বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে
বিরূপ আবহাওয়া কিংবা বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের শঙ্কা দেখা দিলেই চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন। তৎক্ষণাৎ ঝুঁকি এড়াতে নগরীর লালখান বাজারের মতিঝরনা, নাছিয়াঘোনা, বাটালি হিল, ফিরোজশাহ হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন এলাকা, আকবর শাহ ও পাহাড়তলী এলাকার পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে নিরাপদে আনা হয়। পরে ‘যেই লাউ সেই কদু’। স্থানীয় ভূমিদস্যুদের ছত্রছায়া ও পাহাড়ে মৃত্যুঝুঁকির ‘বসতি ব্যবসা’ শুরু হয়। আর এসব নিয়ে কোনো হেলদোল নেই প্রশাসনের।
মৃত্যুঝুঁকি সত্ত্বেও বন্ধ হয় না ‘বসতি ব্যবসা’। এভাবে যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীর ২৬টি পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। অথচ নির্বিকার প্রশাসন কার্যকর উদ্যোগ নেয় না।
জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার এবং বাকি দশটি ব্যক্তিমালিকানাধীন। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে মালিকানাধীন পাহাড় রয়েছে সাতটি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের রয়েছে দুটি, গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর একটি, আমিন জুট মিলের একটি, ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় রয়েছে তিনটি, এপির একটি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন রয়েছে ১১টি পাহাড়। জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এই ২৬টি পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবার বসবাস করে আসছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৩১তম সভায় বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও এডিসি (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীনের সভাপতিত্বে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। নগরীর ২৬টি পাহাড়ে অবৈধ বসতি রোধে ইউটিলিটি সার্ভিস লাইনগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সরবরাহ প্রতিষ্ঠানকে নিজ উদ্যোগে তা সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে তা বাস্তবায়ন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব পাহাড় দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যু, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় নেতা এবং পাহাড় মালিকদের যোগসাজশে তারা টাকার বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। মতিঝরনা ও বাটালি পাহাড় এলাকায় কাঁচা ও আধা পাকা ঘর, বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। তবে সেখানে যারা বসতি করছে, তারা প্রায় সকলেই নিম্ন আয়ের মানুষ। কম ভাড়ায় ঝুঁকি নিয়ে সেখানে বসতি করছে। তাদের উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু ভূমিদস্যু চক্রের মাধ্যমে তারা আবারও সেখানে বসতি গড়ে তোলে।
এদিকে প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী মতিঝরনা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩১টি পরিবারের বসতি রয়েছে। এই পাহাড়ের মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে হলেও তাদের অব্যবস্থাপনা ও খেয়ালিপনার কারণে একটি ভূমিদস্যু চক্র কাঁচা ও আধা পাকা ঘর, বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে। প্রশাসন ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, মতিঝরনা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে নির্মিত শত শত বাড়িঘর ও দোকানের ভাড়া নেওয়াদের মধ্যে অনেকের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন হাজারী, সাবেক কাউন্সিলর এএফ কবির আহমেদ মানিক, আবুল হাসনাত বেলাল, দিদারুল আলম মাসুম, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান, আলমগীর হোসেন এবং চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের সভাপতি এবং সাবেক কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনিসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে। এসব ভাড়া তুলতে তারা বেশকিছু লোক নিয়োগ দিয়েছে। তারাই মাস শেষে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে টাকা তুলে দেন।
বছরের পর বছর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোধ ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও এডিসি (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় সময় পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়ে থাকে। এরপরও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোধ করা যাচ্ছে না। এতে স্ব স্ব এলাকার স্থানীয় ভূমিদস্যু চক্র জড়িত। তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কারা এসব পাহাড় দখল করে ঘর ভাড়া দিয়েছে, তার একটি তালিকা করা হচ্ছে। তা বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’
তবে স্থানীয় ভূমিদস্যুদের পকেট ভারী করতেই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পাহাড় দেখভালের জন্য পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নিলে পাহাড়ে এতগুলো পরিবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসতি গড়ত না। মূলত বিভিন্ন দলের স্থানীয় ভূমিদুস্যদের পকেট ভারী করতেই এসব বিষয়ে স্থায়ী উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত পাহাড় দখল রোধ ও ধসে মৃত্যু ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। না হলে প্রাণহানি ঠেকানো যাবে না।
তথ্যমতে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড় ধসে এক দিনে ১২৭ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। মর্মান্তিক এই ঘটনার পর নগরীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটি ইতোমধ্যে ১৮ বছর পার করলেও কার্যকর ও ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ এই ১৮ বছরে নগরীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসে প্রায় সাড়ে ৩০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এরপরও ২৬টি পাহাড়ে ৬৫৫৮টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যানুসারে, চট্টগ্রাম নগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে মালিকানাধীন সাতটির মধ্যে ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নং ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৪ হাজার ৪৪৬টি পরিবার, মতিঝরনা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩১টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয়নগর পাহাড়ে ২৮৮টি, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২টি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে ৭৪টি পরিবার।
গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর মালিকানাধীন পাহাড়ে বাটালি হিল ও মতিঝরনা অংশের পাহাড়ে ৮৮টি পরিবার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দুটি পাহাড়ের মধ্যে ফিরোজশাহ হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৪৯টি ও কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে ১৪৬টি পরিবার।
১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত তিনটি পাহাড়ের মধ্যে জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন উত্তর পাহাড়তলী এলাকার পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ১২টি, আকবরশাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯টি ও পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে বসবাস করছে ৪৩টি পরিবার।
এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ১১টি পাহাড়ের মধ্যে লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩টি পরিবার, হারুন সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪টি, নাছিয়াঘোনা এলাকার পাহাড়ে ১২টি, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮টি, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯টি, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি, নাগিন পাহাড়ে ২৫টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮টি, এমআর সিদ্দকীর পাহাড়ে ৪২টি, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯টি এবং রৌফাবাদ ও অক্সিজেন এলাকার ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে বসবাস করছে ১১টি পরিবার।