মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ০৯:০১ এএম
রংপুর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ চার কিশোরীর মধ্যে দুজনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধার হওয়া কিশোরীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিশু-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। এদিকে সমাজসেবা কার্যালয় ওই কেন্দ্রে বসবাসকারীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিরাপদ আশ্রয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের এমন কর্মকাণ্ড সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার দ্রুত সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, নগরীর দেওডোবা ডাংগীরপাড় এলাকায় অবস্থিত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র। এতে বর্তমানে প্রায় ৬৮ জন নিবাসী রয়েছে। যেখানে হারিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী, এতিম ও মামলা সংক্রান্ত কারণে আদালত থেকে পাঠানো শিশু-কিশোরীরা থাকছেন। গত ১২ জুন রাতে এ কেন্দ্র থেকে নিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামে চার কিশোরী নিখোঁজ হয়। পুলিশ দুদিন পর গত রবিবার স্মৃতি ও কৃতিকে উদ্ধার করে। ওই দিন পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে পুনরায় সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) পাঠায়। কিন্তু আদালতের বারান্দায় থাকা স্মৃতির মা মুক্তি বেগম মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে আপত্তি জানান। কারণ হিসেবে পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেয়ের ওপর নির্যাতন ও তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত বলে জানান। মুক্তি বেগম তার মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নয়, থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখতে পুলিশের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু আদালতের আদেশ ছাড়া এটি সম্ভব নয় বলে জানায় পুলিশ।
মুক্তি বেগম বলেন, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, রাতে পুরুষ মানুষের আসা-যাওয়াসহ নানা অনিয়ম চলে। এ ছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্মৃতি নিখোঁজ হলে থানায় তিনি জিডি করতে চান। কিন্তু জিডি করতে ‘দেয়নি’ সমাজসেবা কর্মকর্তারা। অবস্থা বেগতিক দেখে সমাজসেবা কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন এবং থানায় জিডি করেন। স্মৃতিকে খুঁজে পাওয়ার পর তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে বাধাও দেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরতরা।
পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া নিবাসী স্মৃতি বলেন, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। প্রতি রবিবার একজন পুরুষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে নিবাসী মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। এরপর ওই মেয়েটির ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এখন তাকে কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে না।’
স্মৃতির সঙ্গে আলাপচারিতা চলাকালে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত এক নারী উদ্ধার হওয়া অন্য মেয়ে কৃতিকে টেনে নিয়ে দ্রুত আদালতপাড়া ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা কিশোরীকে নিয়ে কেন পালিয়ে যাচ্ছেনÑ এমন প্রশ্ন করলে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত ওই নারী এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। তাৎক্ষণিক বক্তব্য নিতে চাইলে নিবাসী কৃতি মুখ খোলেনি।
মিঠাপুকুর থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘মিঠাপুকুর থানার মামলায় কৃতি নামের মেয়েকে আদালতের মাধ্যমে পূনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। মেয়ের মা ফোন করে আমাদের জানিয়েছে তার মেয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর রংপুর চিড়িয়াখানা এলাকায় পাওয়া গেছে।’
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অনিল চন্দ্র বর্ম্মনের বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমি কিছু বলতে পারব না।’
মানবাধিকার ও পরিবেশ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এএএম মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘যে শিশু-কিশোরীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া ও দেখভালের জন্য রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ যদি হারিয়ে যায়, নিরুদ্দেশ হয়, নির্যাতনের শিকারের অভিযোগ করে তাহলে তা উদ্বিগ্নের বিষয়।’
রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে চার কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জিডি হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দুজন কিশোরীকে। বাকি দুজনকে উদ্ধারে কাজ চলছে।’