রাসেল মাহমুদ, বরগুনা
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৫ ১৭:৩০ পিএম
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫ ১৭:৩৬ পিএম
উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লবণাক্ত পানির কারণে অনেক বাসিন্দা বাড়িতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। শহরের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত জলাবদ্ধতা ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণেও বেড়ে গেছে মশার বংশবিস্তার। ফলে বরগুনা এখন ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এডিস মশা নিধনে প্রশাসনিক উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন অনেক।
বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিনেই ৮৬১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। মে মাসে এ সংখ্যা ছিল ৭৮৪ জন, এপ্রিল মাসে ১৮০ জন। গত দুই মাসে মোট ভর্তি ছিল ৯৯৪ জন। অথচ জুনের অর্ধেকে সেই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে রোগীর ভিড়। জেলার মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৩ জনে। বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ২১৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ৬৫ জন, ছাড়পত্র পেয়েছে ১০৮ জন, আর মোট সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৬৮৯ জন। এ ছাড়া চলতি মাসে এখন পর্যন্ত জেলায় মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের, যার মধ্যে গত রবিবার ৩ বছরের একটি শিশুর মৃত্যু বরগুনাবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ৯৯৪ জনের। তবে গত দুই সপ্তাহে আটজন মারা গেছে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে। এর বাইরেও ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে বরগুনার আরও অন্তত ৯ জন।
স্থানীয় বাসিন্দা ডেঙ্গু রোগী সুজন বলেন, ‘মোগো বরগুনা মোগো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইছে, মোরা কতটা অনিরাপদ। এখনও কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে পুরো বর্ষাকালে আর কিছু না, শুধু লাশের খবরই শুনতে হইব।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) আগেই সতর্ক করেছিল, কিন্তু জেলা প্রশাসন জলাশয় ও জলাবদ্ধস্থানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
কী কারণে বরগুনায় ডেঙ্গু প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে তার বিস্তারিত গবেষণা করতে গতকাল সোমবার আইইডিসিআর থেকে ছয় সদস্যের একটি গবেষণা দল বরগুনায় যায়। তারা তিন কার্যদিবসের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেবে।
এদিকে বরগুনার ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু ১২২টির মধ্যে মাত্র ২৬টির বৈধ লাইসেন্স আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে নেই ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্র বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি ভুল রিপোর্ট দিয়ে রোগীদের হয়রানির অভিযোগও উঠেছে।
সরকারি হাসপাতালের অবস্থাও ভয়াবহ। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ১৯২ জন ডেঙ্গু রোগী। রোগীরা মেঝেতে, লিফটের সামনে, করিডোরে এমনকি সিঁড়ির গোড়াতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিটি রোগীর সঙ্গে থাকে ৩-৪ জন স্বজন। ফলে হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন আলেয়া বেগম নামে এক ডেঙ্গু রোগী। তিনি বলেন, ‘রোগী আর স্বজনের চাপ সামলাতে হাসপাতাল কার্যত জর্জরিত।’
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত সুলায়মান বলেন, ‘তিন দিন ধরে ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছি। চিকিৎসা মোটামুটি পাচ্ছি। তবে অনেক রোগী বরিশাল পাঠাচ্ছে, আমাকেও বরিশালে পাঠাতে বলেছিল, কিন্তু টাকার অভাবে এখানেই আছি।’
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রেজয়ানুল আলম বলেন, ‘অতিরিক্ত ১০ জন ডাক্তার ও ১০ জন নার্সের বরাদ্দ হলেও এখন পর্যন্ত ৩ জন ডাক্তার যোগ দিয়েছেন। আমরা চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছি। তবে অতিরিক্ত অ্যাটেনডেন্টের কারণে অনেক সময় সমস্যা হচ্ছে।’
বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘বরগুনায় থেমে থেমে বৃষ্টি ও ভ্যাপসা গরমÑ এডিস মশার বিস্তারের আদর্শ পরিবেশ। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। গবেষণা দলের রিপোর্ট আসার পর বিস্তারিত কারণ জানা যাবে। তবে এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।’