ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫ ১৬:০৬ পিএম
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫ ১৯:৪৮ পিএম
দেশে প্রথমবারের মতো দুটি জলাভূমিকে ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছে সরকার। এতে প্রত্যাশা করা হচ্ছেÑ সেখানে থাকা কালেম, কোড়া, ডাহুক, গুড়গুড়ি, জলপিপিসহ শতাধিক প্রজাতির পাখি, উভচর, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস বিদ্যমান থাকবে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে যাওয়া প্রাণীগুলোও বেঁচে থাকবে।
সম্প্রত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন শাখা-২ থেকে জারি করা পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২-এর ১৩ (২) ধারার ক্ষমতাবলে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার বিলজোয়ানা মৌজার ১.৬৫ একর এবং গোদাগাড়ি উপজেলার বিলভেলা মৌজার ১৫.০৮ একর জলাভূমিকে ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়।
অভয়ারণ্যের অবস্থান সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিলজোয়ানার বিলের জে এল নং-১৪৩, আর এস খতিয়ান নং-১, দাগ নং-৩২, বিলের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম চারদিকেই বিল। অপরদিকে বিলভেলার বিলের জে এল নং-৩৬৭, আর এস খতিয়ান নং-১, দাগ নং-৮০, বিলের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম চারদিকেই ধানিজমি।
এলাকাবাসীর দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রত্যাশা
বিল দুটিকে ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ করতে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করছে রাজশাহী জেলার তানোর ও গোদাগাড়ি উপজেলার মানুষ। তা ছাড়া আলোকচিত্রী, গবেষক, পরিবেশকর্মীদেরও সহায়তা ছিল। পরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করলে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়।
এ সম্পর্কে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লার রহমান বলেন, আমরা ২০০৮ সাল থেকে এই বিল দুটিকে অভয়ারণ্য ঘোষণা দাবিসহ এখানকার পাখি ও অন্যান্য প্রাণীকে রক্ষায় কাজ করছি। এখন অভয়ারণ্য ঘোষণা করায় খুব ভালো লাগছে। এখানে ৬০ প্রজাতির বেশি পাখির দেখা যাওয়া যায়।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহীর জুনিয়র ওয়াইল্ড লাইফ স্কাউট মো. সোহেল রানা বলেন, এখানে প্রতি বছর দেশি ও পরিযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বেগুনি কালিম, জলময়ূর, বালিহাঁস, শামুকখোল, পানকৌড়ি, রাঙাচেগা, পাতি চাকা ইত্যাদি। তা ছাড়া স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি দীর্ঘ ১০ বছর যাবত এটিকে দেখভাল করছে। প্রাকৃতিক এই মনোরম পরিবেশ দেখতে প্রতি বছর এসব স্থানে অনেক দর্শনার্থী আসে।
এদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ অঞ্চলে ২০১৯ সালে পাতিসরালি পাখি দেখা গেছে ৩ হাজার ও ২০২১ সালে ৪ হাজার, লালঝুঁটি-ভূতিহাঁস ৫০ ও ২০০টি, গিরিয়া হাঁস ১২ ও ২০০টি, টিকি-হাঁস ৫০, পিয়াং হাঁস ৪০০ ও ১ হাজার, কালাপাখ-ঠেঙ্গি ৫০ ও ২০টি, গেওয়ালা-বাটান ৫০টি, চা পাখি ২৮০ ও ৪০০টি, প্রশান্ত সোনাগিরিয়া ২০০টি, পাতি ভূতিহাঁস ২৫০ ও ৭৫০টি, বেগুনি বক ৪ ও দুটি, কানি বক ১০০ ও ৫০টি, বাজলা বক ১০০ ও ৪২টি, শামুকখোল ৪০০ ও ১ হাজার, পানকৌড়ি ৫০০ ও ২০০টি, খাটো কান পেঁচা দুটি, বড় বক ১০ ও ১৫টি, মাছ মুরাল দুটি, সাপ পাখি ৪ ও তিনটি, ধুপনি ১০০, কালা মাথা গাংচিল চারটি, পশ্চিমা কানা কাপাসি দুটি, চখাচখি ১০০, পাকড়া মাছরাঙা ১০টি, পাতি মাছরাঙা ৫০টি, সাদা বুক মাছরাঙা ১০টি। অর্থাৎ ২০১৯ সালে এ অঞ্চলে ২৮ প্রজাতির ৫ হাজার ৫৯৩টি পাখির দেখা মিলে ও ২০২১ সালে তা ৯ হাজার ৭১২টিতে পৌঁছে।
জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণার কারণ
বিলজোয়ানা ও বিলভেলায় শীতকালে দেশি এবং পরিযায়ী পাখির অন্যতম আশ্রয়স্থল। বিল দুটিতে কালেম, কোড়া, ডাহুক, গুড়গুড়ি, জলপিপি, জলময়ূরসহ দেশি জলচর পাখির পাশাপাশি বালিহাঁস, পাতিসরালি, বড় সরালি, পিয়াংহাঁস, খুন্তেহাঁস, ভূতিহাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী হাঁসের দেখা মিলে। পাশাপাশি সেসব স্থানে শতাধিক পাখি ছাড়াও উভচর, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস রয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানবসৃষ্ট চাপে এই জলাভূমির জীববৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকির মুখে। অভয়ারণ্য ঘোষণার ফলে এখন থেকে এই এলাকাগুলোতে পাখি ও বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী, গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য শিক্ষাক্ষেত্রে পরিণত হবে বলেও প্রত্যাশা করা হয়েছে।
কী বললেন বিশেষজ্ঞরা
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, যেকোনো জায়গাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে হলে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের জন্য গবেষণা করতে হয়, যেটাকে ‘বেইজ লাইন জরিপ’ বলে। প্রাপ্ত জীববৈচিত্রের মধ্যে সেখানে কোনো বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে এমন প্রাণী আছে কি না, তা দেখতে হয়। কোনো এলাকায় বেশ কিছুসংখ্যক প্রাণী বিলুপ্তির আশঙ্কা থাকলে, সেখানকার বাসস্থানটি ঝুঁকির মধ্যে পড়লে তখন অভয়ারণ্য ঘোষণা করার যৌক্তিকতা তৈরি হয়।
তিনি বলেন, অভয়ারণ্যের সংজ্ঞা তো আমরা মেনে চলি না। কেননা অভয়ারণ্যের অর্থ হচ্ছে সেখানে কোনো কিছু করা বা প্রবেশ করা নিষেধ। মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ না করতে পারলেও সীমিত করে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে। রাজশাহীর বিলভেলা, গহমাবোনা, পবা এলাকাগুলোকে যে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হলো এটি একটি ভালো উদ্যোগ। জলাশয়ভিত্তিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে এই ধরনের অভয়ারণ্য খুবই কার্যকারী।
অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, তার গবেষণা দল, বিশেষ করে আশিকুর রহমান সোমেসহ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের জলাভূমিগুলোতে এমনকি সেই এলাকার নদীর দুই তীরসহ পার্শ্ববর্তী জলাভূমিতে, বিভিন্ন বিল, বিভিন্ন নদীর ধারে ২০১৭-২০২২ সালে সর্বপ্রথম তারা গবেষণা কার্যক্রম, বিশেষ করে পাখি জরিপ করেছিলেন। সেসব জায়গায় তারা বেশ কিছু বিপন্ন প্রজাতির পাখির সন্ধান পেয়েছিলেন যেমনÑ মানিকজোড়, দেশি গুটি ঈগল, বড় গুটি ঈগল, Black necked Ibis-সহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির বিপন্ন পাখি ও সরীসৃপ দেখা গেছে; যা দেশের অন্য এলাকায় খুব কমই দেখা যায় বা বিলুপ্তির পথে। এই এলাকার জলাশয়গুলোকে এবং বিলগুলোকে অভয়ারণ্য ঘোষণা না করলেও কমপক্ষে ইসিএ বা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে করে দেশের যে বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
এই এলাকাটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়া ও পদ্মা নদী থাকায় অনেক বিপন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণী টিকে আছে বলে জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব, বন্য প্রাণী পরিবেশবিদ ও গবেষক আশিকুর রহমান সমী। তিনি ছাত্রজীবন থেকে বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী ও পাখি নিয়ে কাজ করছেন। রাজশাহী অঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, এই এলাকাটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়া ও পদ্মা নদী থাকায় অনেক বিপন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণী টিকে আছে। এ প্রাণীগুলো মূলত অনিয়ন্ত্রিত এলাকায় রয়েছে। রাজশাহী বিভাগে এ ধরনের ২১টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে শুধু রাজশাহী জেলায়ই ১৮টি। তিনি বলেন, দেশে ৩০ প্রজাতির বুনোহাঁস আছে আর বিল দুটিতে এক দিনেই দেখা মেলে ১০ প্রজাতির বুনোহাঁসের। বিভিন্ন কারণে তাদের আবাসস্থল নষ্ট, জমি জবরদখল হওয়ায় পাখিদের জীবন বর্তমানে হুমকির মুখে।
আশিকুর রহমান সমী বলেন, এ দুটি বিল পাশাপাশি। এটি মূলত সরকারি খাসজমি হওয়ায় প্রচুর জবরদখল হয়েছে। মানুষ জবরদখলমুক্ত করতে আন্দোলন করেছে। তিনি বলেন, জবরদখলকারীরা এমনভাবে জলাভূমির উদ্ভিদগুলোকে তুলে ফেলছিল, যেখানে পাখিরা ডিমে তা দিচ্ছিল। এ ধরনের দৃশ্যও তাদেরকে থামাতে পারেনি। বিপন্ন মদনটাক পাখিও সেখানে ছিল। মানিকজোড়ও সেখানে দেখা যায়। বিভিন্ন প্রজাতির ঈগল, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, বাগডাশ, খাটাশের দেখা মেলে। তা ছাড়া কুড়া জাতীয় পাখির আধিক্য আছে।
আশিকুর রহমান সমী বলেন, এটিই দেশে প্রথম ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ এলাকা। এতে করে এখানে দখল করতে পারবে না। বন বিভাগ নিয়মিত তদারকি করতে পারবে। তা ছাড়া আশপাশের এলাকাগুলোর বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।