নিম্নচাপের প্রভাব
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৫ ২২:৪৬ পিএম
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করেছে। এর প্রভাবে টানা দুই দিন ধরে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার কবলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা, প্লাবন ও জনজীবনের চরম বিপর্যয়।
শুক্রবার (৩০ মে) বৈরী আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, রংপুর, কক্সবাজারসহ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন, বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে অনেক এলাকায়। প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদকদের পাঠানো প্রতিবেদনেÑ
সমুদ্র উত্তাল থাকায় দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। স্থলভাগ অতিক্রম করলেও নিম্নচাপটির প্রভাবে আরও একদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে ভোলার মনপুরায় নির্মিতব্য বেড়িবাঁধের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় ওমর নামে এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, নির্মিতব্য ওই বেড়িবাঁধের ওপর দর্শনার্থীরা ঘুরতে গেলে বালুর নিচে চাপা অবস্থায় শিশুটির পা দেখতে পায়। পরে স্থানীয়রা এসে বালু খুঁড়ে শিশুটির মরদেহ বের করে। শিশুটি স্থানীয় কুলাগাজীর তালুক গ্রামের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মনির হোসেনের ছেলে বলে জানান মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহসান কবির।
প্লাবিত ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী
প্রবল বৃষ্টিপাত ও সমুদ্রের স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের কারণে ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, নোয়াখালীসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল পানির নিচে চলে গেছে। ভোলার নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোর অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বসতভিটা। স্থানীয় এক নারী বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। থাকার মতো একটা ঘর পর্যন্ত নেই। না খেয়ে বসে আছি।’
বরগুনায় মানিকখালি ও উত্তর ডালভাঙা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির তোড়ে ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে, গবাদিপশু হারিয়েছে অনেক পরিবার।
পটুয়াখালীর বাউফলে তেঁতুলিয়া নদীপারের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ধসে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকায় নৌকা ও ট্রলার পাঠিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হলেও অনেকেই এখনও পানিবন্দি।
ভোলার মনপুরায় বালুর নিচে চাপা পড়ে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। গলাচিপায় অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, ৫৫/৩ পোল্ডারের ১৫ ফুট বাঁধ ভেঙেছে। রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে ৩-৪ ফুট পানি প্রবেশ করেছে। কলাপাড়ায় কুয়াকাটার সি-বিচ সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে, তলিয়ে গেছে ১০টি গ্রাম।
জেলায় অন্তত ৬ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি। কৃষি ও মাছের খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান জানান, বেড়িবাঁধ মেরামতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলায় ৮৪ মেট্রিক টন চাল, প্রতি উপজেলায় তিন লাখ টাকা করে শুকনো খাবার এবং ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে দ্রুত সহায়তা বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা।
নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে অতিবৃষ্টি, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়া অঞ্চলে নদীতীরবর্তী তিনটি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকাগুলোতে চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত (২৮৫ মি.মি.) রেকর্ড করা হয়েছে। হাঁটুপানি জমে গেছে সড়ক ও বসতঘরে। চট্টগ্রাম বিভাগের সন্দ্বীপ, পতেঙ্গা, বাঁশখালী, আনোয়ারা অঞ্চলেও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে পানিতে ডুবে গেছে বহু এলাকা। পতেঙ্গা সৈকতের কাছে দুটি জাহাজ উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে উপকূলে ধাক্কা খেয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এসব অঞ্চলের বহু গ্রামে। মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে ঘরবাড়িতে। সমুদ্র উত্তাল থাকায় পতেঙ্গায় দুটি জাহাজ ঢেউয়ের তোড়ে তীরে আছড়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর হাতিয়ার সঙ্গে দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফেরি ও ট্রলার চলাচল পুরোপুরি বন্ধ।
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ ও অমাবস্যার প্রভাবে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারে গত তিন দিনে ২০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নদীতীরবর্তী বাঁধের কাজ ঝুলে থাকায় প্রতিটি জোয়ারে আতঙ্কে দিন কাটছে উপকূলবাসীর। জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। দুই শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটবিহীন অবস্থায় রয়েছে দুই উপজেলার সাড়ে সাত লাখ মানুষ।
কমলনগরের নবীগঞ্জে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ থাকায় এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগে। স্থানীয়রা জানান, ঠিকাদার পালিয়ে যাওয়ায় কাজ থেমে গেছে। চরফলকন, চরমার্টিন, চরলরেন্সসহ একাধিক ইউনিয়নে পানি ঢুকে ঘরবাড়ি ডুবেছে। কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় ৩ কিলোমিটার বাঁধ এখন হুমকির মুখে।
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার জানান, শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে, তবে এখনই বন্যার শঙ্কা নেই। নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান জানান, বাঁধ নির্মাণ চলমান রয়েছে, ধীরগতির ঠিকাদারদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
খাগড়াছড়ির মাইনী নদীতে নিখোঁজ বৃদ্ধ
টানা ১২ ঘণ্টার বৃষ্টিতে নদীর পানি বেড়ে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় মাইনী নদীতে তরিৎ চাকমা নামের এক ব্যক্তি নিখোঁজ হন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রশাসন সতর্কতা জারি করলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি।
মহিষ ভেসে গেছে নদীতে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও খামার
ঝড়ের কারণে ভোলায় নদীতে ভেসে গেছে ২০০ থেকে ২৫০টি মহিষ। স্থানীয়দের সহায়তায় কিছু মহিষ উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশের হদিস নেই। মাছের ঘের ও চিংড়ি খামার ধ্বংস হয়ে গেছে। ঝালকাঠি, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে পানি ঢুকে গেছে শস্যখেত, পানের বরজ ও ফলবাগানে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দিশাহারা অবস্থায় দেখা গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৬ মিলিমিটার। চট্টগ্রামের মাইজদীকোর্টে ২৮৫ মি.মি. এবং চাঁদপুরে ২৪১ মি.মি. বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘শুক্রবার গভীর নিম্নচাপটি স্থলভাগ অতিক্রম করেছে। তাই আজ শনিবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সাইক্লোন আকারে বড় ধরনের বিপদ নেই।’
তিনি আরও বলেন, সাগরে বায়ুতাড়িত বাতাস থাকায় দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
উপকূলীয় জেলা প্রশাসনগুলো জরুরি ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও নোয়াখালীতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড প্রস্তুত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরর থেকে জানানো হয়েছে, বাঁধ মেরামত, শুকনো খাবার বিতরণ ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। তবে এখনও বহু এলাকা পানিবন্দি থাকায় সব জায়গায় সহায়তা পৌঁছানো যায়নি।