প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫ ২১:০২ পিএম
বেশ কিছুদিন থেকে অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করার অভিযোগে ‘বাংলাদেশিদের’ আটক করে বাংলাদেশে পুশইন করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। এর অংশ হিসেবে আরও ৯০ জনকে পুশইন করেছে তারা। গত বুধবার মধ্যরাত থেকে বৃহস্পতিবার (২২ মে) ভোর পর্যন্ত দেশের ছয়টি সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়।
যার মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজনের কোমরে প্লাস্টিকের খালি বোতল বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ওই ৯০ জন সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। পুশইনের শিকার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যমতে, আরও অনেকে পুশইনের শিকার হয়েছেন, যাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করতে পারেনি। বিজিবি জানিয়েছে, সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিজিবির টহল দল ২৪ ঘণ্টাই সচেতন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের পাঠানো প্রতিবেদনে বিস্তারিতÑ
ফেনী সীমান্তে ২৪ জনকে পুশইন
ফেনী সীমান্তে ২৪ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ। বৃহস্পতিবার ভোরে ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার সীমান্তে তাদের পুশইন করা হয়।
বিজিবি জানায়, ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার যশপুর ও খেজুরিয়া বিওপির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে ৬টি পরিবারের ২৪ বাংলাদেশি নাগরিককে বিএসএফ বাংলাদেশে প্রবেশ করায়। স্থানীয়দের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে বিজিবি ও পুলিশ ঘটনাস্থলেই তাদের আটক করে। ২৪ জনের মধ্যে পুরুষ ৬ জন, মহিলা ৫ জন ও ১৩ জন শিশু রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই কুড়িগ্রামের বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আটককৃতদের ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
ফেনী ৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে বিএসএফ কর্তৃক ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় তাদের আটক করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
সীমান্তে বাতি নিভিয়ে ২১ জনকে পুশইন
সীমান্ত বাতি নিভিয়ে পঞ্চগড়ের সদর উপজেলায় জয়ধরভাঙ্গা বড়বাড়ি সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুসহ ২১ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। বুধবার ভোর ৪টার দিকে নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বড়বাড়ি সীমান্তের মেইন পিলার ৭৫৭ এর ১০ নম্বর সাব পিলার এলাকা দিয়ে তাদের বাংলাদেশে পুশইন করা হয়। পরে জয়ধরভাঙ্গা বিওপির টহল দল তাদের আটক করে। এর মধ্যে ছয়জন নারী, দুজন পুরুষ ও ১৩ জন শিশু। তারা সবাই খুলনা ও নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকার নাগরিক।
আটকদের মধ্যে ছয়জন নারী ও একজন পুরুষের বিরুদ্ধে বিজিবির পক্ষ থেকে সদর থানায় পাসপোর্ট আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। বাকিদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আটককৃত ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ২১ মে ভারতীয় পুলিশ তাদেরকে গুজরাট এলাকা থেকে আটক করে বিমানযোগে কলকাতা নিয়ে আসে। পরে বাসযোগে বুধবার মধ্যরাতে বিএসএফের ৯৩ ব্যাটালিয়নের টিয়াপাড়া ক্যাম্পে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে তাদেরকে টিয়াপাড়া বড়বাড়ি সীমান্ত গেট দিয়ে বাংলাদেশে পুশইন করে। তারা বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশের বড়বাড়ি এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন। স্থানীয়রা বিজিবির স্থানীয় জয়ধরভাঙ্গা ক্যাম্পে খবর দিলে ক্যাম্পের টহল দল তাদের আটক করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর থানায় তাদের নিয়ে যায় বিজিবি।
পঞ্চগড় সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এইচএসএম সোহরাওয়ার্দী বলেন, নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ২১ জনকে আটকের পরে বিজিবি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চলমান।
নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের ব্যাটালিয়ন কোম্পানি ও ক্যাম্প কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা বিজিবি পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা দায়ের করব। তবে যারা শিশুর রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়। সীমান্তে বিজিবি সর্বদা সচেতন আছে। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিজিবির টহল দল ২৪ ঘণ্টা সীমান্তে কড়া টহলে রয়েছে।
লালমনিরহাট সীমান্তে পুশইনের শিকার ২০ জন পুলিশ হেফাজতে
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্ত দিয়ে পুশইনের শিকার শিশুসহ ২০ জনকে আটক করেছে বিজিবি। আটকদের মধ্যে সাত শিশু ও ১১ জন নারী ও দুজন পুরুষ রয়েছেন। তাদেরকে পাটগ্রাম থানায় রাখা হয়েছে।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, বুধবার মধ্যরাতে উপজেলার গাটিয়ারভিটা সীমান্ত এলাকার ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ার গেট খুলে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বিএসএফ ও ভারতীয় পুলিশ। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে বিজিবি তাদের আটকের পর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বর্তমানে তারা পাটগ্রাম থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানায়, গাটিয়ারভিটা সীমান্ত দিয়ে পুশইন হয়ে দেশে ঢোকার পর তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে হেঁটে পাটগ্রামের দিকে যেতে শুরু করেন। তবে স্থানীয় নতুন বাজারে পৌঁছলে বাজারের লোকজনের সন্দেহ হয়। তাদের আটকে পর জিজ্ঞাসাবাদ করলে ভারত থেকে পাঠানো হয়েছে বলে তারা স্বীকার করেন। আটককৃতদের বরাতে স্থানীয়রা দাবি করেন, ওই সীমান্ত দিয়ে শুধু ২০ জন নয়, দুই দফায় অন্তত ৫০ জন বা তারও অধিক ব্যক্তিকে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে। যাদের অনেকেই পুলিশ ও বিজিবি চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে।
আটককৃতদের মধ্যে আদরী, সীমা ও শাহানা জানান, ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৪ হাজার অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের আটক করে সেদেশের পুলিশ। তাদের মধ্যে ১৮৬ বাংলাদেশিকে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে বুধবার বিকালে একটি বিমানে শিলিগুড়ি বাগডোগরা বিমান বন্দরে আনা হয়। এরপর তাদেরকে ১৫ থেকে ২০ জন করে কয়েকটি গাড়িতে তুলে লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা হয়।
করেছেন পাটগ্রাম থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, আটকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
কোমরে বোতল বেঁধে পাঁচ জনকে নদীতে ফেলল বিএসএফ
খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার ফেনী নদী সংলগ্ন কাজির চর সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ একই পরিবারের পাঁচ সদস্যকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। গত বুধবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গভীর রাতে ভারতীয় ১১৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা পরিবারের পাঁচ জনকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। পরে ভোরে স্থানীয় গ্রামবাসীরা তাদের উদ্ধার করে বিজিবিকে খবর দেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে ৪৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের মহামুনি বিওপির সদস্যরা পরিবারটিকে আটক করে নিজেদের হেফাজতে নেয়।
উদ্ধার হওয়া উম্মেদ আলী জানান, তারা ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের একটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কয়েক দিন আগে বিএসএফ হঠাৎ তাদের আটক করে। এরপর তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। নদীতে ফেলার আগে কোমরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেয়, যেন তারা ডুবে না যায়।
রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ইসমত জাহান জানান, মানবিক কারণে পরিবারটিকে রামগড় হাই স্কুলে বিজিবি ও পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাদের খাবার, বিশ্রাম ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, আমরা ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। তারা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় নাগরিক কি না, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাচাই শেষে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কুমিল্লা সীমান্তে ১৩ জনকে পুশইন
কুমিল্লায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১৩ জনকে ভারত থেকে পুশইন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে কুমিল্লা সদর উপজেলার গোলাবাড়ি সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
কুমিল্লা ১০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর আলী এজাজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জনান, ভোর ৪টার দিকে কুমিল্লা সদর উপজেলার গোলাবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিএসএফ তাদেরকে পুশইন করে। ৬০ বিজিবি টহলদল তাদের আটক করে। এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, তিনজন নারী এবং সাতজন শিশু রয়েছেন। আটকদের বিজিবি হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই শেষে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
কুলাউড়া সীমান্তে শিশুসহ ৭ জনকে পুশইন
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে দিয়ে শিশুসহ ৭ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে উপজেলার মুরইছড়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে বিজিবি সদস্যরা ওই সাতজনকে আটক করেন। আটককৃতদের মধ্যে দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও তিন শিশু রয়েছে। তারা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।
এ বিষয়ে ৪৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএসএম জাকারিয়া বলেন, আটক ব্যক্তিরা সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। তাদেরকে কুলাউড়া থানায় হস্তান্তর করা হবে।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম আপছার বলেন, বিজিবি আটক ব্যক্তিদের থানায় হস্তান্তর করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন লালমনিরহাট প্রতিবেদক, ফেনী প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি প্রতিবেদক, কুমিল্লা প্রতিবেদক, কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিবেদক এবং পঞ্চগড় প্রতিবেদক।