× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গাছ আর খাবারের সংকটে হুমকিতে শহরের বণ্যপ্রাণী

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫ ১০:০২ এএম

গাছ আর খাবারের সংকটে হুমকিতে শহরের বণ্যপ্রাণী

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বারান্দার টবে বেগুন গাছ লাগিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছিল অনির্বাণ বিশ্বাসের পরিবার। গাছে বেগুন না ফললেও পাতার নিচে একদিন তারা দেখতে পান একটি ছোট পাখির বাসা। বিষয়টি তাদের কাছে এক আবেগময় আনন্দের উপলক্ষ হলেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় শিগগিরই তারা বাসাটি ছেড়ে দেবেন। নতুন ভাড়াটিয়া সেই বাসা রক্ষা করবে কি না, তা অনিশ্চিত।

এই উদ্বেগের পেছনে রয়েছে ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলে বন্য প্রাণীদের জন্য ক্রমবর্ধমান সংকট। শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে আজ যারা বেঁচে আছে, তাদের জীবন অনেকটাই নির্ভর করছে মানুষের করুণার ওপর।

অনির্বাণ বিশ্বাসের বাড়িতে প্রতিদিন পাখির জন্য রাখা হয় খাবার ও পানি। সকাল-বিকাল পাখির কিচিরমিচিরে ভরে থাকে বাড়ির আঙিনা। একইভাবে তেজগাঁওয়ের গৃহিণী হিরা আক্তার বারান্দায় চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি খাবার ও পানি দিয়ে রাখেন। এতে শহরের কাক, বুলবুলি, চড়ুইসহ নানা পাখি সেখানে এসে খায়, কিচিরমিচিরে মুখরিত করে পরিবেশ। হিরা আক্তারের কথায়, পাখিকে আটকে না রেখে বরং খাবার দিলে তারাই আসবে, আবার নিরাপদে ফিরে যাবে।

শুধু পাখি নয়, শহরের কিছু পরিবার শহুরে পরিবেশে টিকে থাকা অন্যান্য প্রাণীদেরও আশ্রয় দিয়েছে। কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় শরিফুল ইসলামের বাড়িতে তিন প্রজন্ম ধরে ডজনখানেক বেজি বাস করছে। সেই বাড়ির চারপাশে ঝোপঝাড়, গর্ত ও গাছপালা তাদের আবাস তৈরি করে দিয়েছে। তেজগাঁও বনফুল এলাকাতেও দেখা গেছে, বেজি ও বিড়াল একই স্থানে সংঘাতহীন সহাবস্থানে আছে।

পুরান ঢাকার নারিন্দায় বানরের দলকে নিয়মিত খাবার দেয় ‘সাধনা ঔষধালয়’। একসময় কয়েক হাজার বানর থাকলেও এখন সংখ্যা নেমে এসেছে কয়েকশতে। খাবার ও বাসস্থানের অভাব, বিদ্যুৎ লাইনের শর্টসার্কিটসহ নানা কারণে তারা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। শহরের মধ্যে যেসব এলাকায় আগে বানর বা অন্যান্য প্রাণী খাবার পেত, এখন সেসব জায়গা কমে গেছে।

রমনা পার্কে গত মঙ্গলবার দেড় ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, জাম গাছে ফলে ভরপুর থাকায় সেখানে পাখিদের আনাগোনা তুলনামূলক বেশি। ভাতশালিক, গোবরে শালিক ছাড়াও কাঠবিড়ালির দেখা মেলে। মাটিতে পড়ে থাকা পুরনো জাম, বাদাম খুঁটে খাচ্ছে তারা। পার্ক রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার সদস্য চান মিয়া জানান, প্রতিদিন এখানকার পাখিরা মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার ও গাছের ফলমূল খেয়েই বাঁচে।

তবে এমন সহাবস্থানের সুযোগ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। শহরের অধিকাংশ গাছ কাঠজাতীয়। ফলে ফুল-ফল নেই, যা পাখি বা বন্য প্রাণীদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন করে তোলে। পার্কে বিশ্রামরত মধ্যবয়সি আওলাদ হোসেন বলেন, ফলদ গাছ কম। ইউক্যালিপটাস ও আকাশী গাছ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার বিকল্প ফলদ গাছ রোপণের উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

বাংলাদেশ সেইফ ফুড ইফোর্টস ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. জয়নুল আবেদিন জানান, কীটনাশকও একটি বড় হুমকি। বন্য প্রাণীরা সরাসরি না খেলেও, মানুষের খাবার থেকে কীটনাশকের চক্রাকারে তাদের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে। কাকও কমে গেছে। শহরের ফেলে দেওয়া খাবার খেয়েই কাক, বানর, বেজি, কাঠবিড়ালি টিকে থাকে, তাই নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা জরুরি।

তিনি জৈবনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর পক্ষে মত দেন, ফলদ গাছে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে মৌমাছি, উপকারী পোকামাকড় মরে যাচ্ছে। পাখিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, শহরে বটগাছ বা অশ্বত্থগাছও কমে গেছে। এগুলো বিস্তৃত শিকড় ও ডালপালার কারণে রাস্তার পাশে সমস্যা তৈরি করলেও পাখিরা এর ওপর নির্ভর করে থাকে। কাক কী খাবে? এখন আর কেউ ভাত ছিটিয়ে দেয় না। ডাস্টবিনগুলো পাখির নাগালের বাইরে। ফলে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা যেভাবে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করছি, তাতে ড্রেনে ব্যাঙ বাস করতে পারে না। অথচ অনেক পাখি ব্যাঙ, মাছ, পোকা-মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। এই পানি নদী ও জলাশয়ে গিয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।

পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, বেশিরভাগ পাখি মানুষের খাওয়া খাবার খায়। আবার মাছ, ব্যাঙ, ইঁদুরসহ অন্যান্য প্রাণীও পাখিদের খাদ্য। তাই শুধু ফলদ গাছ নয়, মানুষের ফেলে দেওয়া নিরাপদ খাদ্যও তাদের বাঁচার উপায়।

ঢাকা শহরে কত ধরনের বন্য প্রাণী আছে তা নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান। ২০১৫ সাল থেকে ঢাবির বন্য প্রাণী রিসার্চ ল্যাবরেটরির অধীনে শুরু হওয়া গবেষণাটি চলবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। তার মধ্যে একটি পর্বের গবেষণা শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। শহরের ২২টি অঞ্চলে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ২০১৫-২০১৮ সালে ২০৯টি বন্য প্রাণী প্রজাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬২টি পাখি, ১৯টি সরীসৃপ, ১২টি উভচর ও ১৬টি স্তন্যপায়ী প্রাণী। সব মিলিয়ে ১৩ হাজার ৮০০-এর বেশি বন্য প্রাণী গণনা করা হয়েছে।

ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, শহরের গাছপালা, তৃণভূমি এবং নগরের কিছু অঞ্চলই বন্য প্রাণীদের শেষ আশ্রয়। কিন্তু দূষণ, নির্মাণ, যান চলাচল, কীটনাশক ও অপরিকল্পিত নগরায়ন তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে। সমাধানে তিনি ১২ মাস ধরে ফুল-ফল পাওয়া যায় এমন গাছ লাগানোর সুপারিশ করেন।

আইইউসিএনের গবেষণায় আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছেÑ গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১টি বন্য প্রাণী প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেছে। বিপন্ন ১৮১টি, মহাবিপন্ন ৫৬টি, ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫৩টি প্রজাতি।

আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস আজ

আজ ২২ মে, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য—‘বিপন্ন বৈচিত্র্যের রক্ষা চাই, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে চাই।’ প্রাণ ও প্রকৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সময় এসেছে আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়ার।

বন্য প্রাণী রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিক, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই পৃথিবী কেবল মানুষের নয়, সব জীববৈচিত্র্যের সম্মিলিত আবাস।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা