ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫ ০৯:৫২ এএম
‘শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারী’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতেছে ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানের শ্রমিক জেসমিন আক্তার
চা-পাতার ঝোপে লুকানো ছিল এক নারীর দীর্ঘ চার দশকের শ্রম, ঘাম আর নিঃশব্দে বয়ে চলা সংগ্রামের গল্প। বয়সের ছাপ পড়েছে গায়ে, কিন্তু হাতের গতি এখনও থেমে যায়নি। ফটিকছড়ির নেপচুন চা-বাগানের শ্রমিক জেসমিন আক্তার। যিনি জীবনের প্রায় ৪২টি বছর কাটিয়েছেন চা-পাতা উত্তোলন করে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো হলেন দেশের শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারী। ২০২৪ সালে একাই উত্তোলন করেছেন ৩৪ হাজার ৯৩৭ কেজি চা-পাতা। আর সেই শ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চা দিবসে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এই অর্জন শুধু তার একার নয়, এটি এক সংগ্রামী নারীর, একটি পরিবারের এবং একান্ত নিবেদিত শ্রমজীবী শ্রেণির সম্মানও বটে।
জেসমিন আক্তারের বয়স এখন ৬০ ছুঁই ছুঁই। স্বামীর হাত ধরেই মূলত চাগাছের সঙ্গে পরিচয় তার। ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কুমিল্লা থেকে স্বামী আবদুল বারেকের সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানে। সেখানে সংসার শুরুর পরপরই স্বামীর সঙ্গে লেগে পড়েন চা বাগানের কাজে। এভাবেই চা-পাতার সঙ্গে শুরু হয় তার মিতালী। একটি-দুটি পাতা উত্তোলন করতে করতে এখন হয়ে গেছেন দেশসেরা। টানা দ্বিতীয়বারের মতো পেলেন পাতা উত্তোলনকারীর (চয়নকারী) পুরস্কার। সারা দেশে সর্বোচ্চ চা-পাতা চয়নকারী শ্রমিক হিসেবে জেসমিন আক্তার বাংলাদেশ চা বোর্ডের এই পুরস্কার পেয়েছেন।
গতকাল বুধবার ঢাকায় জাতীয় চা দিবসের অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। টানা দুবার শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারী হওয়ায় অতিথি পর্যায়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পায় জেসমিন আক্তার। তুলে ধরেন চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া।
দেশসেরা হওয়ার পেছনের গল্প জানতে গত মঙ্গলবার গিয়েছিলাম জেসমিনের কর্মস্থল ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট ইউনিয়নে অবস্থিত ইস্পাহানি গ্রুপের মালিকাধীন নেপচুন চা বাগানে। সেখানে কথা হয় জেসমিনের সঙ্গে। তার চা-পাতা উত্তোলনের মাঝে রয়েছে এক ধরনের ছন্দ।
সেরা হওয়ার পেছনে কী জাদু এমন প্রশ্ন করলে জেসমিন জানান, ‘বেশি পাতা উত্তোলনের জন্য বিশেষ কোনো জাদু নেই।’ ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কুমিল্লা থেকে স্বামী আবদুল বারেকের সঙ্গে চলে আসেন ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানে। সেখানে সংসার শুরুর পরপরই স্বামীর সঙ্গে লেগে পড়েন চা বাগানের কাজে। ৪২ বছর ধরে সেই কাজই করে চলেছেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে তার জীবন সংগ্রাম শুরু তাই সবসময় চা-পাতা নিয়েই ভাবনা তার। কীভাবে দুটো পয়সা বেশি পাবেন, সেই চিন্তা থেকে চেষ্টা করেন অন্যদের চেয়ে একটু বেশি চা-পাতা উত্তোলনের। এজন্য তার চিন্তা চেতনা-ধ্যান সবকিছু চা-পাতাকেন্দ্রিক। একাগ্রতা আর চা-পাতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি পৌঁছে গেছেন সর্বোচ্চ স্থানে।
তিনি বলেন, আজ দেশসেরা হতে পেরে সত্যি আনন্দিত। ছেলেমেয়ে ও স্বামীসহ সংসারের ৮ সদস্য এই বাগানে কর্মরত। এতে আমি গর্বিত।
তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর আগে আমাদের বাগানের আরেক শ্রমিক উপলক্ষ্মী সেরা হয়ে পুরস্কার জিতেছিল। তারপর আমি টানা দুইবার আমি পেলাম। বিশেষ করে সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের মতো ক্ষুদ্র শ্রমিকদের কাজের মূল্যায়নের জন্য।
তার স্বামী বারেক পাতা সংগ্রহকারী না হলেও বাগানে অন্য কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, মেয়ে ও মেয়ের জামাইও চা বাগানে কাজ করেন। পরিবারের আট সদস্য চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে জেসমিন আকতার আরও বলেন, নাতি-নাতনিদের আমাদের মতো শ্রমিক পেশায় নিতে চাই না। তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই।
পরপর দুবার তার এ সাফল্যে খুশি বাগানের অন্যান্য শ্রমিকরাও। তারা জানান, আমাদের বাগান থেকে প্রথমে উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা এরপর টানা দুবার জেসমিন চা-পাতা তুলে দেশসেরার পুরস্কার পেয়েছে। এজন্য আমরা অনেক খুশি! আমরা চাই সে আরও সফল হোক। এ ছাড়া চা শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান নেপচুনের চা শ্রমিকরা।
এমএম ইস্পাহানি গ্রুপের নেপচুন চা বাগানের ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘দেশের ১৬৮টি চা বাগানের মধ্যে নেপচুন চা বাগান থেকে টানা তিনবার দেশসেরা চা শ্রমিক বা পাতা চয়নকারী নির্বাচিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জেসমিন আক্তার সেরা হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা চাই জেসমিনের মতো অন্য শ্রমিকরাও সেরা হোক।’
১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় ২ হাজার ৭০০ একর আয়তন বিশিষ্ট পাহাড়-সমতল এলাকায় গড়ে উঠে ইস্পাহানি গ্রুপের নেপচুন চা বাগান। ২০০৯ সালে বৃক্ষরোপণে দেশসেরা চা বাগান মনোনীত হয় বাগানটি। ২০২০ সালে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ডে মনোনীতও হয় এ বাগান। দীর্ঘ ৬৫ বছরে এ বাগান নানা সফলতার পাশাপাশি চা উৎপাদনেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।