ফুয়াদ মোহাম্মদ সবুজ, মহেশখালী (কক্সবাজার)
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫ ১২:৪২ পিএম
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষত ইজিবাইক ও ডাম্পার এই দুটি বাহনের বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ ও পশুপাখি। সড়কে চলাচল যেন এখন জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইজিবাইক বাহন হিসেবে পরিবেশবান্ধব হলেও অদক্ষ চালকের হাতে পড়ে তা হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। অন্যদিকে, বালু ও নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ভারী ডাম্পারগুলো এখন মহেশখালীতে মরণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই যানবাহনগুলো রাতদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে, নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ, নেই কার্যকর আইন প্রয়োগ।
সম্প্রতি পানিরছড়া রবি বাজার এলাকায় ডাম্পারের ধাক্কায় মারা গেছে একটি মুখপোড়া হনুমান। খাদ্য সংকটে লোকালয়ে ছুটে আসা এই নিরীহ বন্য প্রাণীর মৃত্যু স্থানীয়দের হৃদয়বিদারকভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসা একটি ডাম্পার হনুমানটিকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। অনেকে মনে করছেন, এটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং সড়ক নিরাপত্তার বেহাল দশার একটি প্রতীক।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল গফুর বলেন, এই ডাম্পারগুলোর কারণে মানুষ তো দূরের কথা, পশুপাখিও নিরাপদ নয়। এর আগে শিশু ও বৃদ্ধরাও এসব গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, বরং কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত দুই বছর ৯ মাসে মহেশখালীর বিভিন্ন সড়কে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে পথচারী। আহতরা চিকিৎসা নিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাশের চকরিয়া হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে। তবে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একাংশ চিকিৎসার জন্য নির্ভর করছেন ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাম্য চিকিৎসকদের ওপর, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
ইজিবাইক ও ডাম্পার চালকদের অধিকাংশেরই নেই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স। তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ। সড়কে ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা, রাস্তায় ওভারটেক, যত্রতত্র স্টপেজ তৈরি, এসব তাদের নিয়মিত চর্চা। এ কারণে ব্যস্ততম সড়কে প্রায়ই দীর্ঘ যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটছে।
২০২২ সালের ১৪ জুলাই পানিরছড়া ও বড় মহেশখালীতে দুটি শিশুর মৃত্যুর পর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইয়াছিন ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ ডাম্পারের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে। তবে বাস্তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই উদ্যোগ ছিল লোক-দেখানো। প্রশাসন কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এ প্রসঙ্গে মহেশখালী নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বলেন, মাতারবাড়ি-চালিয়াতলী ও গোরকঘাটা সড়কে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কের বেহাল অবস্থা, ড্রাইভিং লাইসেন্সহীন চালক, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলাচলের অনুমতি এসবের পেছনে বড় কারণ।
তারা আরও বলেন, শুধু সড়ক সংস্কার করলেই হবে না। চালকদের প্রশিক্ষণ, ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই, রুট পারমিট ছাড়া গাড়ি চলাচল বন্ধ, ফুটওয়ে নির্মাণ এবং সড়কের পাশে মালামাল ওঠানামা নিষিদ্ধ করতে হবে। সবকিছুই হতে হবে স্বচ্ছ প্রশাসনিক নজরদারির মাধ্যমে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেদায়েত উল্যাহর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সচেতন নাগরিকদের প্রশ্ন, কেন প্রশাসন এতটা নীরব? জনপদের মানুষ কেন প্রতিদিন অনিরাপদ সড়কে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করবে? প্রশাসনের এই দায়সারা ও অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়েই দাপট দেখাচ্ছে এসব যান।
ইজিবাইক কিংবা ডাম্পার পরিবেশবান্ধব সহায়ক হলেও যদি তা হয় অদক্ষ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত, তবে সেটি জনজীবনের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়। এখনই কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রশাসনিক জবাবদিহি এবং কার্যকর নজরদারির মাধ্যমে মহেশখালীতে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা হলে, আগামী দিনগুলোতে প্রাণহানি ও জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে।