ফারুক আহমাদ আরিফ, সুবল বড়ুয়া, নুপা আলম ও ফুয়াদ মোহাম্মদ সবুজ
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১২:১৮ পিএম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:৫৯ পিএম
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া সাগরপাড়ে ধ্বংসপ্রায় বেড়িবাঁধের চিত্র
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াল রাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাংলাদেশ উপকূলে। রাতভর প্রায় ২৫০ কিলোমিটার গতির ঝড়ো হাওয়া ও ১৫-২০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও সন্দ্বীপের উপকূল অঞ্চল। এখনও এসব এলাকার মানুষ ভুলতে পারেনি সেই বিভীষিকাময় ঘূর্ণিঝড়ের কথা। তবে ৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও উপকূল সুরক্ষিত করা হয়নি। যার ফলে আতঙ্কে দিনপার করছে উপকূলের বাসিন্দারা।
৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের ৪০ শতাংশ ভূমি সাগরে বিলীন হয়। বর্তমানে ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি নিয়মিত জোয়ারে প্লাবিত হয়। জীবন রক্ষায় স্থানীয়রা বাঁশ ও মাটির বাঁধ দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা সামান্য ঢেউয়েই ভেঙে যায়।
৯১ সালে মা-বোনসহ চার নিকটাত্মীয়কে হারানো বাঁশখালীর বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক জালাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে আমার মা, ছোট বোন, নানি ও মামাতো বোন প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি তাদের লাশও খুঁজে পাইনি। আমার বাবাও এই ঝড়ে ভেসে গিয়েছিলেন। সাত দিন পর বাবাকে মুমূর্ষু অবস্থায় খুঁজে পাই। এভাবে আমার মতো পশ্চিম বাঁশখালীতে এই ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।’
মাতারবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা রুনা আক্তার বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে আমরা প্রতি বছর নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী বেড়িবাঁধ ছাড়া মহেশখালী মানুষের শান্তি আসবে না। আমরা চাই, ‘সুপার ডাইক’ প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা হোক। যেন আমরা নিরাপদে বাঁচতে পারি, আমাদের সন্তানরা নির্ভয়ে ঘুমাতে পারে।
বাড়ছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা
সমুদ্রে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বঙ্গোপসাগরসহ অন্যান্য সাগর-মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ওশেন ইক্সট্রিমস এসএ স্ট্রেস টেস্ট ফর মেরিন ইকোসিস্টেম অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক গবেষণায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণাটিতে বলা হয়, ‘২০২৩-২৪ সালে এশিয়াজুড়ে একাধিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছে। সেখানে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা ও ২০২৪ সালে রেমাল। এই দুটি ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে ৯০ লাখের অধিক মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, উপকূলীয় এলাকায় ১৯৬০ সালে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে সিসি ব্লক ঢালাই ও মাটির বাঁধ দিয়ে বেড়িবাঁধের সংস্কার করা হয়। পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭ সালে), নারগিস (২০০৮ সালে) এবং আইলায় (২০০৯ সালে) বেড়িবাঁধ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাউবোর (বিভাগ-১) নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আনোয়ারায় ৮ কিলোমিটারের মধ্যে ইতোমধ্যে ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে। এখন দুই দশমিক ৮০০ কিমি বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ চলছে। বাকি বেড়িবাঁধগুলোও অনুমোদনক্রমে বাস্তবায়ন হবে।’
মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ী এলাকার জন্য ‘সুপার ডাইক’ নির্মাণে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ জামাল মুর্শিদ জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে অনুমোদন মিলতে পারে এবং ২০২৯ সালের মধ্যে মহেশখালীবাসী একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী বেড়িবাঁধের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
২৯ এপ্রিল স্মরণে মানববন্ধন
দুর্যোগ প্রশমনে ঋণের ওপর নির্ভর না করে জাতীয়ভাবে স্ব-অর্থায়নে আঞ্চলিক অগ্রাধিকার পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ৩৪ বছর : উপকূলীয় মানুষের সুরক্ষা ও নাগরিক সমাজের দাবি’ শীর্ষক মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। ইকুইটিবিডির মোস্তফা কামাল আকন্দের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী।