জব্বারের বলী খেলা
আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৩৭ পিএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৪৭ পিএম
চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ। প্রবা ফটো
পশ্চিমের আকাশে তখন সূর্য হেলে পড়েছে। ঘণ্টাখানেক আগেও ছিল সূর্যের তেজ। সূর্য অস্ত যেতে যেতে তেজ কমতে থাকলেও গোধূলি বেলায় হাজারো মানুষের উল্লাস আর হুংকার আরও উত্তাপ ছড়াচ্ছিল চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ে। লালদীঘির ময়দান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। আশপাশের ভবনের ছাদগুলোতেও যেন তিল ধারণের ঠাঁয় নেই।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে লালদীঘির পাড়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলীখেলা ঘিরে। হাজারো মানুষের সম্মিল্লিত এই উল্লাসের কেন্দ্রে ছিলেন কুমিল্লার দুই বলী ‘বাঘা’ শরীফ ও মো. রাশেদ।
বন্দরনগরীর ঐতিহাসিক এই বলী খেলার ১১৬ তম আসরে দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনাল লড়েছেন কুমিল্লার এই দুই বলী। এর মধ্যে বাঘা শরীফ আবার মো. রাশেদের শিষ্য। আগেরবার ১১ মিনিটের লড়াইয়ে একপর্যায়ে গুরুর কাছে আপোষে হার মানা রাশেদ এবার অবশ্য জেতার জন্য মরিয়া ছিলেন। তবে দীর্ঘ প্রায় আধা ঘন্টার লড়াইয়ে এবারও না হেরে রানার্স আপ হয়েই থাকতে হলো তাকে। দীর্ঘ লড়াইয়ে কেউ কাউকে হারাতে না পারায় এবারও গতবারের মতো সমঝোতায় একজনকে চ্যাম্পিয়ান, অন্য জনকে রানার্স আপ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন পরিচালকরা। তবে এতে বাধ সাধেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি চাইছিলেন খেলাতেই জয় পরাজয় নির্ধারণ হোক। এরপর আরও প্রায় ১০ মিনিটেও কোনো ফলাফল না এলে একপর্যায়ে লড়াইয়ের মধ্যে বাউন্ডারি লাইনের দড়ি আঁকড়ে ধরেন রাশেদ। আর সেটাকেই নিয়ম ভঙ্গ দেখিয়ে শরীফকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেন পরিচালকরা। এর মধ্যে দিয়ে টানা দ্বিতীয় বারের মতো জব্বারের বলী খেলার চ্যাম্পিয়ন হলেন বাঘা শরীফ। আর দ্বিতীয় বারের মতো না হেরেই রানার্স আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে রাশেদকে।
জানা যায়, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই খেলার সূচনা করেন তিনি।
এবারের আসরে ফাইনাল খেলা দুই বলীই কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার বাসিন্দা। এর আগের আসরেও চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হয়েছিলেন এই দুইজন। তার আগের আসরে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন একই উপজেলার শাহজালাল বলী। সেই শাহজালাল বলীর শিষ্য এই দুই বলী। ৮০ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দুজনই হলেন চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ। বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সদস্য সচিব ও আব্দুল জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল জানান, এবার বলী খেলায় ১২০ জন নিবন্ধন করেছিলেম। তাদের মধ্যে ৮০ জনকে বাছাই করে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত করা হয়।
এবারের আসরে প্রথম ধাপে ৪০ জন বলী চ্যাম্পিয়ন হন। তাদের মধ্য থেকে চারজন ও গত আসরের সেরা চারজন খেলোয়ার মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান।
৩৫ বছর বলীখেলা পরিচালনা করে দুই বছর আগে অবসরে গেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এমএ মালেক। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আগের আসরের সেরা চার বলী আর এবারের আসরের প্রথম রাউন্ড জয়ী ৩৫ জনের মধ্য থেকে চারজনকে নিয়ে মূল আসর হয়। জয়ীদের মধ্যে কৌশল ও সুঠাম স্বাস্থ্য দেখে বিচারকরাই চারজনকে নির্বাচিত করেন।’
প্রতিবারের মতো এবারও কোতোয়ালি মোড় থেকে শুরু করে আন্দরকিল্লা ও লালদীঘি মোড় থেকে সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন দেশি ও লোকজ পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছে মেলা। দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের ভিড়ে এসব এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। লালদীঘির ময়দানেও ছিল উপচেপড়া ভিড়।
অন্যান্য সময় মূল মঞ্চের আশপাশে কিছু জায়গা ফাঁকা থাকলেও এবারের মঞ্চের পাশ ঘেঁষে ছিল মানুষের সমাগম। ভিড় সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
মূল মঞ্চের পাশে কথা হয় দুই পোশাকশ্রমিক সুমি আক্তার ও সোহানা বেগমের সঙ্গে। অষ্টাদশী এই দুই তরুণী এসেছেন বায়েজিদ এলাকা থেকে। তারা বলেন, এবারই প্রথম বলী খেলা দেখতে এসেছি। ভিড় ঠেলে মঞ্চের সামনে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে খেলা দেখে ভালো লাগছে।
এদিন বিকাল ৪টায় লালদিঘী মাঠে এ প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেম চট্টগ্রাম সিটির মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
খেলা শেষে চ্যাম্পিয়নকে ৩০ হাজার, রানার্সআপকে ২০ হাজার, তৃতীয় বলীকে ১০ হাজার ও চতুর্থ বলীকে ৫ হাজার টাকাসহ ট্রফি তুলে দেন অতিথিরা। পাশাপাশি প্রথম রাউন্ডে বিজয়ীদের প্রত্যেককে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা করে।