জিয়াউর রহমান, নেত্রকোণা
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৪০ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৫০ এএম
কৃষকের ফসল রক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছেন এক হিরালি। প্রবা ফটো
হাওরের বোরো ফসল ও ঘরবাড়ি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন শিলাবৃষ্টি, ঝড়-তুফান এবং বজ্রপাতের কবল থেকে রক্ষা করতে গ্রামের কৃষকরা এক সময় তন্ত্রসাধক হিরালিদের দ্বারস্ত হতেন। হিরালিরা বিশেষ করে কৃষকদের বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে অগ্রিম সতর্ক বার্তা দিতেন। আর বিনিময়ে ফসল ঘরে তোলার পর কৃষকরা খুশি হয়ে তাদের ধান, চাল, মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য উপহার দিতেন। তা দিয়েই চলত হিরালি পরিবারগুলোর সংসার। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে আগের মতো আর কদর নেই হিরালিদের। তাই পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের। তবে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় খুঁজে নিয়েছেন।
নেত্রকোণা একটি কৃষি প্রধান জেলা। এ জেলার প্রধান ফসলই হচ্ছে বোরো ধান উৎপাদন। বিশেষ করে জেলার হাওরাঞ্চল মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরীসহ অন্তত ৬টি উপজেলা বোরো ধান উৎপাদন হয়। বোরো ধান দিয়েই চলে হাওরাঞ্চলের মানুষ।
গত দুই যুগ আগেও হাওরাঞ্চলের প্রতি গ্রামেই হিরালিদের আনাগোনা ছিল। তাদের কদরও ছিল অনেক। কৃষকরা তাদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। জমিতে বোরো ধান রোপণের পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হিরালিরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের ফসল রক্ষায় আগাম সতর্ক বার্তা দিতেন। শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ঝড়-তুফান কেমন হবে, কোন কোন এলাকায় বেশি হবে। কোন কোন হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছেÑ এসব বার্তা তারা দিতেন এবং কৃষকদের তা প্রতিরোধের উপায়ও বাতলে দিতেন। অনেক সময় কৃষকরা তাদের দেওয়া আগাম বার্তার যথার্থতাও খুঁজে পেতেন।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে কৃষকরা আবহাওয়া বার্তা পেয়ে যান। তাই তন্ত্রসাধক হিরালিদের তেমন কদর নেই। দিন দিনই বিলোপ হচ্ছে এই লোকাচারের।
তবে নেত্রকোণার কয়েকটি উপজেলায় এখনও হিরালিদের দেখা মেলে। বংশ পরম্পরায় জেলার অন্তত অর্ধশত হিরালি পরিবার আজও এ পেশার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আগের মতো তাদের চাহিদা ও কদর না থাকায় পরিবার নিয়ে তারা কষ্টে আছেন। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রাম। গ্রামটিতে এখনও সত্তর বছর বয়সি হাছু মিয়া হিরালি, পঞ্চান্ন বছর বয়সি ইদ্রিস আলী হিরালিসহ অন্তত ৭-৮টি হিরালি পরিবার রয়েছে। তারা বংশ পরম্পরায় এ পেশা ধরে রেখেছেন। জেলার বিভিন্ন হাওর এলাকায় ঘুরে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে কৃষকদের হাওরের ফসল রক্ষায় সতর্ক করেন।
জানা যায়, হাছু মিয়া ও ইদ্রিস আলী হিরালি সহোদর ভাই। তাদের বাবা মৃত আমান হোসেন হিরালির পেশা তারা ধরে রেখেছেন। তাদের এলাকায় হিরালি পেশার প্রবর্তক ছিলেন ওসমত হিরালি। ওসমত হিরালিকে নিয়ে এলাকায় অনেক জনশ্রুতি রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী বাবুল সিরাজুল বলেন, ‘হাওরাঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হচ্ছে হিরালি প্রথা। এই পেশাটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। পেশাটি যেকজন এখনও ধরে রেখেছেন সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।’