শাহিনুর রহমান, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১২ এএম
প্রবা ফটো
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শলুয়া-বালুদিয়াড় বিল একসময় ছিল চাষযোগ্য ফসলি জমি। দেড় যুগ আগে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিল কৃষকদের সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য। সেই সময় এই এলাকার আশপাশে কোনো পুকুর ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন এই নলকূপের আওতায় মাত্র ১৪ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ হলেও প্রায় ১১৫ বিঘা জমি পুকুরে রূপান্তরিত হয়ে মাছ চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শুধু শলুয়া-বালুদিয়াড় বিল নয়, চারঘাট উপজেলার চৌধুরীর বিলেও একই চিত্র। এখানে দেড় যুগ আগে গভীর নলকূপ স্থাপনের সময় মাত্র দুটি পুকুর ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই নলকূপের আওতাধীন প্রায় ৯৫ শতাংশ জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। ফলে এই এলাকায় বোরো ধান চাষ হয়েছে মাত্র পাঁচ বিঘা জমিতে, আর মাছ চাষ হয়েছে শতাধিক বিঘা জমিতে।
উপজেলায় বিএমডিএর স্থাপিত ৬৪টি গভীর নলকূপের আশপাশে ফসলি জমির পরিবর্তে হাজার হাজার পুকুর খনন করা হয়েছে। সরকার কৃষকদের সেচ সুবিধা দিতে গভীর নলকূপের পানিতে বিদ্যুৎ খরচে ভর্তুকি দিলেও সেই সুবিধা কৃষকদের চেয়ে বেশি পাচ্ছেন এখন মৎস্য খামারিরা। পানির সহজ লভ্যতা ও কম দামের সুযোগ নিয়ে মাছ ব্যবসায়ীরা কৃষকদের জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করছেন। ফলে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে উপজেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৩ হাজার ৪০২টি। এক যুগ আগে পুকুরের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩০, যা অর্ধযুগে ৬৪০টি। এক যুগে ১ হাজার ৪৭২ নতুন পুকুর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পুকুরগুলোর বেশিরভাগই গভীর নলকূপের সংলগ্ন এলাকায় খনন করা হয়েছে।
শলুয়া, ভাটপাড়া, নিমপাড়া ও চৌধুরীর বিল এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ গভীর নলকূপের আশপাশে কৃষিজমি নেই। ফসলি জমি পরিণত হয়েছে বিশাল বিশাল পুকুরে। গভীর নলকূপের পানি দিনে সেচকাজে ব্যবহার করা না হলেও, রাতভর এসব পুকুরে পানি সরবরাহ করা হয়।
শলুয়া-বালুদিয়াড় বিলে সেচের অভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি দিচ্ছিলেন কৃষক সবুর আলী। তিনি বলেন, ‘সারা রাত গভীর নলকূপ চালিয়ে মাছের খামারে পানি দেওয়া হয়। কিন্তু দিনের বেলায় ফসলের জমির জন্য অপারেটররা পানি দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি এনে চাষ করতে হচ্ছে, যা ব্যয়বহুল। সরকার পানি ভর্তুকি দিলেও সেই সুবিধা আমরা পাচ্ছি না।’
চৌধুরীর বিলের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, এক যুগ আগেও এখানে প্রচুর ফসল হতো। এখন চারপাশে শুধু পুকুর। গভীর নলকূপের পানিতেই এসব খামার টিকে আছে। কিন্তু ফসলি জমিতে পানি চাইলে নলকূপ চালু করতে অপারেটররা গড়িমসি করে। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি সংগ্রহ করছি।
নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর তথ্য অনুযায়ী, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপে ব্যবহৃত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য ৪ টাকা ৮২ পয়সা। অন্যদিকে মৎস্য খামার ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় থাকায় তাদের জন্য বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য ৯ টাকা ৮৮ পয়সা, যা প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু গভীর নলকূপের পানিতে ভর্তুকির সুযোগ নিয়ে মাছ চাষিরা কম খরচে পানি সংগ্রহ করছেন। যা প্রকৃত কৃষকদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শলুয়া-বালুদিয়াড় বিলে বিএমডিএর নলকূপ অপারেটর রবিউল ইসলাম নিজেই ১৮ বিঘা জমিতে মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, আগে এখানে অনেক বোরো ধান চাষ হতো, এখন সবাই মাছ চাষ করছে। তাই আমিও করছি। তবে ক্ষুদ্র কৃষকদের জমিতে পানি না দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, কৃষকদের প্রধান সমস্যা হলো সেচের পানি। অথচ তাদের ভর্তুকির পানিতে মৎস্য খামার গড়ে উঠছে। ফলে কৃষকরা বিকল্প উপায়ে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চারঘাট জোনের সহকারী প্রকৌশলী মো. হানিফ শিকদার জানান, গভীর নলকূপের পানি শুধুমাত্র কৃষিজমিতে ব্যবহারের কথা। কিন্তু বাস্তবে তা মৎস্য খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর চারঘাট জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন কুমার সরকার বলেন, গভীর নলকূপের পানি সেচের কাজে ব্যবহার না করে মাছ চাষে ব্যবহারের কোনো নিয়ম নেই। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ বিভাগে আবেদন করা হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকরা দাবি করছেন, গভীর নলকূপের পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হোক। কৃষিজমি রক্ষায় অনিয়ন্ত্রিত পুকুর খনন বন্ধ করা হোক। ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু নীতিমালা গ্রহণ করা হোক।