ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৫২ এএম
হালদার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সম্প্রতি ফটিকছড়ির ভূজপুর এলাকা। প্রবা ফটো
খরার কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে জোয়ার-ভাটার নদী হালদা। বিস্তীর্ণ এলাকায় চর জাগায় হুমকির মুখে পড়েছে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সেচ সংকট। চাষাবাদ ব্যাহত হয়ে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নদীপাড়ের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। বিশেষজ্ঞদের মতে, হালদার ক্যানসার খ্যাত ভূজপুর রাবার ড্যামের ফলে ভাটি অংশের পানিপ্রবাহ কমে যায়। নদীর নাব্যতা হ্রাস হয়ে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজনন ধ্বংস করছে।
স্থানীয়রা জানান, যুগের পর যুগ হালদা নদীর পাড়সহ বিভিন্ন চরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় সবজি ও বোরো চাষ করে আসছেন। ফটিকছড়ির সমিতিরহাট, রোসাংগিরি, দৌলতপুর, সুয়াবিল, ধুরুং, সুন্দরপুর, ভূজপুর, হারুয়ালছড়ি, পাইন্দং, নারায়ণহাটসহ কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার কৃষক এ চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। হালাদার পানিপ্রবাহের উৎস পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও মানিকছড়ি এলাকার পাহাড়ি ঝরনা থেকে সৃষ্ট মানিকছড়ি, ধুরুং, সর্তাসহ বেশ কিছু খাল শুকিয়ে গেছে। উপজেলার নারায়ণহাট থেকে সমিতিরহাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় ছোট-বড় অসংখ্য চর জেগেছে নদীতে। পানিপ্রবাহ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে সেচকাজ। বালুর চরের নিচু এলাকা দিয়ে সামান্য পরিমাণে পানি নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। সেখান থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে সেচ দিচ্ছেন।
কৃষকরা জানান, পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা হালদা নদী ফটিকছড়ি উপজেলার মধ্যদিয়ে দিয়ে কর্ণফুলীতে মিশেছে। প্রতি বছর বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের বালুতে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। উচ্চতা বাড়ায় পানির ধারণক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে এ নদী প্রায় মৃত হয়ে পড়ে।
উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের আমান উল্লাহ বলেন, ‘এক দশক আগেও নদীর গভীরতা ছিল। তখন নদীতে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ ছিল। নদীর পানি দিয়ে সবজি ও ধান চাষাবাদ করতেন চাষিরা। বিশেষ করে চরে সবজি ও ধান চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন পাড়ের অনেক কৃষক। সেসব এখন শুধুই গল্প।’
সুয়াবিল গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম বলেন, ‘হালদার চরে ৫০ শতক জমি আছে। সেখানে শুধু সবজি চাষ হতো। নদীর পানিই ছিল চরের উর্বরাশক্তির মূল উৎস। তখন পানির অভাব ছিল না। ফলে চরে সবজি চাষ করে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতাম। কিন্তু বর্তমানে পানি না থাকায় চরের জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে না।’
পাইন্দংয়ের কৃষক মো. জসিম বলেন, ‘চরে চার শতাধিক চাষি বোরো ও অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। বর্তমানে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ করতে পারছি না। এখন অভাবে দিন কাটছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলার সমিতিরহাট, রোসাংগিরি, দৌলতপুর, সুয়াবিল, ধুরুং, সুন্দরপুর, ভূজপুর, হারুয়ালছড়ি, পাইন্দং, নারায়ণহাটসহ কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার কৃষক চরের প্রায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমির ফসল উৎপাদন হালদা নদীর পানি সেচের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত এক দশকে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখানে চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফসলি জমি অনেকটাই অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়েছে।’
হালদা গবেষক চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, হালদার ক্যানসার খ্যাত ভূজপুর রাবার ড্যামের ফলে হালদা নদীর ভাটি অংশের পানিপ্রবাহ কমে যায়। ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস করে যা মাছের স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজনন স্থান ধ্বংস করে প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করে। পাশাপাশি নদীতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণী, শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধির হ্রাস করে ফলে নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
তিনি আরও বলেন, নদীর ভাটির অংশে পানির পরিমাণ কমে গেলে কৃষকদের সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকে না, ফলে নদীর তীরের কৃষিজমির উর্বরতা কমে ফসলের উৎপাদন হ্রাস করে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘হালদা নদীর পানির ওপর শুধু সবজি নয়, কয়েকটি বিলের বোরো ধান চাষাবাদও নির্ভরশীল। কিন্তু এটি ভরাট হওয়ায় কয়েকটি শাখা খালও মরে যাচ্ছে। এগুলো খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
পাউবো চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সোহাগ তালুকদার বলেন, ‘হালদায় পানিশূন্য হওয়ার জন্য দায়ী হচ্ছে পরিবেশ। পরোক্ষ দায়ী ভূজপুর রাবার ড্যাম। হালদার মতো নদীতে রাবার ড্যাম করা উচিত হয়নি। যদিও এটি কৃষির জন্য ভালো হয়েছে। কিন্তু এটির একটি বিরূপ প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টি না হওয়াতে হালদার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হালদা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। নদীটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’