শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৪:০৪ পিএম
ঈদের চাহিদা মেটাতে জুতা তৈরির কাজ করছেন একজন কারিগর। শুক্রবার রাজশাহীর চারঘাটের কালুহাটি পাদুকা পল্লীর একটি কারখানা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
কখনও শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত, কখনও ব্যস্ত কারখানার শব্দে প্রাণবন্তÑ এমনই ছিল রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি পাদুকা পল্লী। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ সে পল্লী যেন কেবলই অতীতের স্মৃতি। রাজনৈতিক সেচ্ছাচারিতা, আধুনিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা, ঋণ সংকট ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ধ্বংসের পথে একসময়ের বেকারহীন গ্রাম খ্যাত এ শিল্প এলাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে বড়াল নদীর তীরে গড়ে উঠা এ পাদুকা পল্লীতে ৮২টি কারখানা ছিল। যেখানে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। প্রতি বছর রমজানের সময় এখানকার কারখানাগুলো ৫০-৬০ কোটি টাকার জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি হতো। কিন্তু বর্তমানে সচল মাত্র ১৬টি কারখানা। আর এবারের রমজানে ব্যবসা নেমে এসেছে ২-৩ কোটি টাকায়।
কালুহাটি পাদুকা শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, করোনার পর থেকে ব্যবসার মন্দা চলছে। স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়ায় মূলধন সংকট আরও তীব্র হয়েছে। বাজারে আমাদের হাতে তৈরি পাদুকার চাহিদা কমেছে, কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে, আর মার্কেটগুলোতে বিশাল অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ফলে অনেক কারখানাই চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
কালুহাটির পাদুকা শিল্পের দুরবস্থার জন্য অনেকেই রাজনৈতিক দুর্নীতিকে দায়ী করছেন। স্থানীয় কারখানা মালিকদের অভিযোগ, ২০১৩ সালে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী পর থেকেই তাদের দুর্দশা বাড়তে থাকে। তার আস্থাভাজন জেলা যুবলীগের সহসম্পাদক কামাল হোসেন ও ভাগিনা সোহেল রানা কারখানা না থাকলেও পাদুকা সমবায় সমিতি গঠন করে সরকারি ঋণ ও অনুদানের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
মন্ডল সুজ কারখানার মালিক জাকারিয়া হোসেন বলেন, ঋণ পাওয়ার আশায় তাদের সমিতিতে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে কিছুই জুটলো না। বরং তারা নিজেরাই সেই টাকা ভোগ করে ঋণের পথে আটকে দিয়েছে।
নিউ মান্নান সুজ কারখানার মালিক আব্দুল মান্নান বলেন, আগে দোকানিরা আমাদের থেকে জুতা কিনত, ধীরে ধীরে টাকা পরিশোধ করত। এখন বড় কোম্পানিগুলো সরাসরি দোকানে ডেলিভারি দিচ্ছে। ফলে আমাদের কাছ থেকে কেউ মাল নিচ্ছে না, পাওনা টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণের অভাবে অধিকাংশ কারখানা মালিক ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন না। যদিও ২০২৩ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন ৬৩ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় ১৩টি আধুনিক মেশিন বসায়। তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে প্রকৃত কারখানা মালিকরা এর সুবিধা পাননি।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কামাল হোসেন ও সোহেল রানা আত্মগোপনে চলে যান। সেই সুযোগে বিএনপি সমর্থকরা এসএমই ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে নির্মিত কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার (সিএফসি) দখল করে নেয় ও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে হাতে তৈরি জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজ চললেও গত কয়েক বছরে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি পাদুকার বাজার দখল করে নিয়েছে বড় বড় কোম্পানিগুলো। এর ফলে ক্রেতারা এখন কম দামে উন্নতমানের মেশিন-তৈরি জুতা কিনতে পারছে। আর কালুহাটির কারিগরদের বাজার সংকুচিত হচ্ছে।
শিশির সুজ কারখানার মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ৪ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করার পরও নতুন ঋণ পেলাম না। ব্যবসা চালানোর মূলধন নেই তাই বাধ্য হয়ে বগুড়ার একটি পাদুকা কোম্পানিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি।
উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মহসিন মজুমদার জানান, নিয়ম পরিবর্তনের কারণে অনেক মালিক নতুন ঋণ পাননি। তবে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, আমরা কালুহাটির পণ্যকে স্থানীয় বাজার থেকে বের করে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য স্বয়ংক্রিয় মেশিন সংযোজন, প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী সঠিকভাবে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে অনাগ্রহী।
একসময় দেশের একমাত্র বেকারহীন গ্রাম হিসেবে পরিচিত কালুহাটি পাদুকা পল্লী আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। রাজনৈতিক দুর্নীতি, প্রযুক্তির দৌরাত্ম্য, ঋণ সংকট ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এ শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কালুহাটির পাদুকা শিল্প কেবলই ইতিহাস হয়ে যাবে।