জুলাই আন্দোলনে শহীদদের পরিবারে ঈদ এবার বিষাদের
হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৫ পিএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৬ পিএম
শহীদ ওয়াসিম আকরাম। ছবি : সংগৃহীত
প্রতিবার ঈদের চার, পাঁচ দিন আগেই বাড়ি এসে মাকে জড়িয়ে ধরতেন ওয়াসিম আকরাম। আবদার করতেন ঈদে বেশি করে সেলামি দেওয়ার। ঈদের দিন পছন্দের খাবার তৈরির জন্য মায়ের কাছে বায়না তো থাকতই। সবই আজ স্মৃতি। বুলেটের আঘাত কেড়ে নিয়েছে ওয়াসিমের জীবন। ছেলের নানান আবদারের কথা মনে হলেই এখন ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা জোৎস্না আকতার।
ওয়াসিম আকরাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ। গতকাল ওয়াসিমের কথা তুলতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা জোৎস্না আকতার বলেন, ‘বাড়িতে এসেই সব সময় মা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরত। আমি তার এই জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাক দেওয়া খুব মিস করি। এবার ঈদের নামাজ পড়ে সবাই বাসায় ফিরবে, কিন্তু আমার ওয়াসিম আর আসবে না। আমাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকবে না। ঈদের দিন পছন্দের খাবার রান্না করার জন্য বায়না ধরবে না।’
ওয়াসিম আকরাম কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মেহেরনামা বাজারপাড়া এলাকার প্রবাসী শফিউল আলমের ছেলে। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে ওয়াসিম ছিলেন দ্বিতীয়। পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর এইচএসসি শেষ করে চট্টগ্রাম কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ওয়াসিম।
১৬ জুলাই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। রংপুরে আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রামেও ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনজন নিহত হন। তাদের একজন ওয়াসিম আকরাম। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
জোৎস্না আকতার বলেন, ‘গত কয়েক বছর ওয়াসিম সবার জন্য শহর থেকে শপিং করেছে। রমজান এলে ওর বাবাকে বলতে শপিংয়ের টাকা পাঠানোর জন্য। ওর বাবা টাকা পাঠালে শহর থেকে সবার জন্য কেনাকাটা করে ২৫/২৬ রমজান বাড়িতে আসত। গতবার আমার জন্য শাড়ি, বোনের জন্য জুতা, থ্রি পিস নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এবার ২৫/২৬ রমজান চলে গেল আমার ওয়াসিম আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসিম ঝালজাতীয় খাবার বেশি পছন্দ করত। হালিম তার খুব পছন্দের। ঈদের নামাজ পড়ে এসে আমাকে সালাম করত। ঈদ সেলামি নিয়ে বেরিয়ে যেত, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যেত।’
ওয়াসিমের বাবা শফিকুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রমজান এলেই আমাকে কল করে বলত বাবা বেশি করে টাকা পাঠান। শপিং করতে হবে, কিন্তু রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাকে কেউ আর টাকা পাঠানোর জন্য কল করে না।’
শুধু ওয়াসিম নন, একই শূন্যতা বিরাজ করছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত ১২ শহীদ পরিবারে। এসব পরিবারের ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ঘাতকের বুলেট।
জুলাই অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে ১২ শহীদ হলেনÑ চট্টগ্রাম কলেজের সম্মান শ্রেণির ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের ছাত্রশিবির নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত, আশেকান আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তারুয়া, জুতার দোকানের কর্মচারী শহীদুল ইসলাম, রিকশাচালক জামাল উদ্দিন, কাঠমিস্ত্রি মো. ফারুক, দোকান কর্মচারী মাহিন হোসেন সাইমুন, কার্টন ফ্যাক্টরির কর্মচারী মো. আলম, শ্রমিক মো. ইউসুফ, কলেজ শিক্ষার্থী ইশমামুল হক ও শিক্ষার্থী ওমর বিন নুরুল আবছার।
তানভীর ছিদ্দিকীর বাবা বাদশা মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এবার ঈদ বলে আমাদের কিছু নেই। বড় ছেলেকে হারিয়ে তার মা বাকরুদ্ধ। প্রতিদিন ইফতার আর সেহরির সময় ছেলের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে ওঠে।’
ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কহিনুর আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ঈদ বলে আমার কাছে কিছু নেই। আমার ছেলে ছিল সব আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। এবার সে নেই, তাই এবার আমাদের ঈদের আনন্দও নেই। সে মিষ্টি খাবার বেশি পছন্দ করত। সেমাই খুব পছন্দ কর। ঈদের দিন সেমাই রান্না করতে গেলেই তার কথা মনে পড়বে।’