বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কাপ্তাই (রাঙামাটি) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১০:২৩ এএম
বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নের থাংক্রীপাড়া ঝিড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করছেন গৃহিণী শৈনুচিং মারমা। প্রবা ফটো
দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমের কারণে পানির সংকট দেখা দিয়েছে পুরো পাহাড়ে। একসময় সবুজঘেরা বনাঞ্চল পার্বত্য জেলায় এ সংকট ছিল না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। দিন দিন তা আরও তীব্র হচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ও ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামার ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি। নিরাপদ ও নিত্যব্যবহার্য পানি মিলছে না। তাছাড়া সেসব দূষিত পানি আছে তা পান করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ওইসব এলাকার বাসিন্দা। দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে পানি সংগ্রহ করে এখানকার মানুষ। এতে তাদের দুর্গতি বেড়েছে।
বান্দরবান : পার্বত্য জেলা বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারীদের পানির প্রধান উৎস নদী ও ঝিরি-ঝরনা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে সেসব শুকিয়ে যাওয়া যায়। একসময় বান্দরবানে পানির সংকট ছিল না। অধিক হারে পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বনাঞ্চল উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে এই সংকট আরও তীব্র হয়।
বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত থাংক্রী পাড়া। যেখানে প্রায় ৩০টি পরিবারসহ আরও চারটি পাড়ার প্রায় ৩০০টি পরিবারের দেড় হাজার মানুষের বাস। তিনশ বছরের পুরোনো থাংক্রী পাড়া গ্রামটি দীর্ঘদিন ধরে তীব্র পানি সংকটে ভুগছে। গ্রামের পাশে থাকা থাংক্রী ঝিরি নামক ছোট্ট একটি মরা ঝিরির পাথরের গর্ত থেকে চুইয়ে পড়া পানিই এখানকার মানুষের একমাত্র ভরসা। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে গেলে সেখানে চরম সংকট দেখা দেয়।
সরেজমিন থাংক্রী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের গৃহিণী শৈনুচিং মারমা প্রতিদিনের মতো পানির জন্য প্রায় ৫০০ ফুট উঁচু-পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেয়ে পানি সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, ‘সকালে পানি নিতে পারিনি, কারণ অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই দুপুরে আসতে হলো। পানির জন্য প্রতিদিন এমন কষ্ট করতে হয়।’
এভাবে প্রতিদিন শত শত নারী পাহাড়ি পথ বেয়ে পানির সন্ধানে ছুটে চলেন।
থাংক্রী পাড়ার পাশাপাশি আরও চারটি গ্রামÑ উপর বুড়ি পাড়া, নিচে বুড়ি পাড়া ও সাক্রেডং পাড়া, রোয়াজা পাড়া তীব্র পানি সংকটে। এসব পাড়ায় ৩০০-এর বেশি পরিবারের প্রায় দেড় হাজার মানুষ বাস করে। এসব গ্রামে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় অস্বাস্থ্যকর, ঝিরি-ঝরনা ও দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
জামছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যসিং শৈ মার্মা বলেন, শুধু থাংক্রী পাড়াবাসী পানি সংকটে নেই; পাশাপাশি আরও কয়েকটি গ্রাম সংকটে ভুগছে। এ গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
খাগড়াছড়ি : জেলায় ৬টি গ্রামের প্রায় ৭০০ পরিবার তীব্র পানি সংকটে। নদীসহ ছোট-বড় খাল ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৪ নম্বর পেরাছড়া ইউনিয়নের কাপতলা পাড়া, ভাঙ্গামুড়াসহ ৬টি গ্রামের প্রায় ৭০০ পরিবারের বসবাস। এ পাড়ার একমাত্র পানির উৎস হলো দুটি ছড়া ও ছোট ৩টি কুয়া। তীব্র খরার কারণে কুয়ার পানি শুকিয়ে গেছে। এখন নালার নোংরা পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে তাদের।
এসব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছে, কেবল খরা নয়; নির্বিচারে গাছ কাটা, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে অতিরিক্ত সেগুনগাছ লাগানোর কারণে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
শচী রানী ত্রিপুরা বলেন, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে পাহাড় ডিঙিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। বহু বছর ধরেই ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত এটি প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি আমাদের আশীর্বাদ। তবে সেটিও বাড়ির পার্শ্ববর্তী ঝিরি আর কুয়া থেকেই সংগ্রহ করতে হয় বলে মোটেও তা সুপেয় নয়।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কাপতলা পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট কুয়া বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখেছিলেন এলাকাবাসী। কিন্তু সেটাও এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। যতটুক পানি আছে তা সংগ্রহে লাইন ধরে অপেক্ষা করছে কয়েকজন নারী ও শিশু।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পাহাড়ের অন্যতম একটি বড় সমস্যা সুপেয় পানির অভাব। পাহাড়ে ভূগর্ভে না পাওয়ার কারণে পানির মূল উৎস ছড়া ও কুয়া। পাহাড়ের এ সমস্যা দূর করতে আমাদের বেশ কয়েকটা পরিকল্পনা রয়েছে। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প স্থাপন, ছড়া ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করতে পারি। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব দেওয়া আছে। দিকনির্দেশনা পেলে পদক্ষেপ নেব।
কাপ্তাই (রাঙামাটি) : রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এসব ছড়ার ওপর নির্ভরশীল মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
দেখা গেছে, কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ছড়া, ওয়াগ্গাছড়া, পাগলীপাড়া, রামছড়াসহ বিভিন্ন ছড়ায় বর্তমানে পানির প্রবাহ নেই। বর্ষার সময় যেসব ছড়া দিয়ে উপচে পড়ত পানির স্রোত, সেসব এখন শুকিয়ে কাঠ।
এ বিষয়ে কথা হলে কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা সমিরণ তঞ্চঙ্গ্যা, শানু তঞ্চঙ্গ্যাসহ কয়েকজন জানান, পাহাড়ে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক মানুষ এসব ছড়ার ওপর নির্ভরশীল। ছড়ার প্রবহমান পানি থেকে গোসল, জামাকাপড় ধোয়াসহ দৈনন্দিন কাজ করে থাকেন। কিন্তু পাহাড়ি ছড়াগুলো এখন শুকিয়ে আছে। তাই তাদের দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
কাপ্তাই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী লিমন চন্দ্র বর্মণ জানান, কাপ্তাইয়ের নুনছড়ি মারমা পাড়ায় পানির সমস্যা দূর করতে জিএফএস কাজ হয়েছে। যার মাধ্যমে ঝরনার পানি সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। যেসব দুর্গম এলাকায় পানির সমস্যা রয়েছে, সেখানে কিছু কিছু জায়গায় রিং টিউবওয়েল বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দুর্গম এলাকার মানুষের পানি সমস্যা দূর হবে।