মহাদেবপুর (নওগাঁ) সংবাদদাতা
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ১৭:১৫ পিএম
কৃষিজমিতে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার। প্রবা ফটো
কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরূপ প্রভাব ফসলের মাঠ পেরিয়ে মানবদেহে বিস্তৃত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। উৎপাদিত ফসল হয়ে পড়ছে বিষাক্ত। এসব গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কীটপতঙ্গ দমনের নামে কীটনাশক ব্যবহার পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির সৃষ্টি করছে। বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি এসবে উৎপাদিত ফসল খেলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে কৃষি বিভাগের দাবি, কীটনাশকের যথেচ্ছ প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নওগাঁ জেলার মহদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, উপজেলায় প্রতিবছর ৭২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে ধানসহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন করতে কৃষকরা যে পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করে, তা ভয়াবহ। কৃষকরা প্রতি বিঘা জমিতে ফসল উৎপাদনে প্রায় ৩০০ মিলিগ্রাম কীটনাশক তরল ও ৩০৫ মিলিগ্রাম ছত্রাকনাশক পাউডার ব্যবহার করে থাকে। সেই হিসেবে ৭২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৬৬৫ লিটার কীটনাশক তরল ও ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৪৯ কেজি ছত্রাকনাশক পাউডার প্রতি বছর কৃষকরা ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করছে। যার দাম বাজার মূল্য অনুসারে প্রায় ৩০ কোটি ৫১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি প্রজাতির বীজের বদলে হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের কারণেও কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ বাড়ছে। অধিক ফলনের আশায় বাছ-বিচার ছাড়াই কৃষক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়াচ্ছেন। কীটনাশকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির আরেকটি কারণ- কৃষিক্ষেত্রে দুর্বল ও অপুষ্ট বীজের উপস্থিতি। দুর্বল বীজের মাধ্যমে ফসলের মাঠে যে দুর্বল চারাগাছের উৎপাদন হয় তা সহজেই কীটপতঙ্গের আক্রমণের শিকার হয়। আর এটা রোধে কৃষককে ফসলের মাঠে ব্যাপকমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। এসব কীটনাশক প্রয়োগের ফলে খেতের আশপাশের নদী, নালা, খাল-বিল এমনকি জলাভূমিতে তা ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ, সাপ, ব্যাঙ, মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। কীটনাশক প্রয়োগের এক সপ্তাহ পর ফসল সংগ্রহ করার কথা থাকলেও অনেক কৃষক তা প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করে বাজারজাত করছেন। কীটনাশক স্প্রে করা সবজি, ফল ও খাদ্যশস্য রান্নার পরও এর বিষ নষ্ট হয় না। বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বর শক্তি, পরিবেশ হারাচ্ছে তার জীববৈচিত্র্য আর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগ-ব্যাধিতে।
এ ব্যাপারে মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. খুরশিদুল ইসলাম বলেন, কীটনাশক মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন কৃষি ও প্রাণিজ খাদ্যের মাধ্যমে কীটনাশক মানবদেহে প্রবেশের কারণে মানুষের হার্ট, কিডনি, লিভার, স্নায়ু, ত্বকসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটিযুক্ত সন্তান জন্ম দেওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হয় এই বিষক্রিয়ায়। শুধু তাই নয়, কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় প্রায় প্রতিনিয়ত দুয়েকজন মানুষ কীটনাশক পান করছে। এদের মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে, আবার অনেকে মারা যাচ্ছে। তাই কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
এ ছাড়া প্রায় সব কৃষক কীটনাশক স্প্রে করার সময় তাদের হাত-পা ঢাকার জন্য কোনোকিছু ব্যবহার করে না। হাত মোজা ব্যবহার, নিরাপত্তার জন্য চশমা ব্যবহার এবং কাপড় দিয়ে নাক ঢাকা নিয়ে কৃষকদের যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় তারা জমিতে মুক্তভাবে কীটনাশক ব্যবহার করছেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ইচ্ছামতো কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। কতটুকু জমিতে কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত, এমনকি ফসল তোলার কতদিন আগে ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা উচিত সে ব্যাপারে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধারণা নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ জানান, আমরা আইপিএমসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষককে পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার, ফেরোমোন বড়ি এবং হাত দিয়ে পোকা দমনসহ যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা ধৈর্য ধরতে চায় না। তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে কীটনাশক বিক্রেতাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে একের পর এক বিভিন্ন কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহার করে। যা জমি ও মানবস্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।