নিমসার বাজার
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫ ০০:০৪ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৫ ০৫:২২ এএম
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি নিমসার সবজি বাজার। প্রবা ফটো
কুমিল্লা বুড়িচংয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি নিমসার সবজি বাজার আগামী এক বছরের জন্য ৫ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৯১৫ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। গত ১২ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার এ সংক্রান্ত একটি আদেশ দরপত্র বিজয়ী কুমিল্লা নগরীর আব্দুল জলিলের হাতে তুলে দেন। পরবর্তী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ইজারার সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। বাংলা সন অনুযায়ী দেশের হাটবাজার ইজারা দেওয়া হয়।
তবে বাজারের স্থানীয় ক্ষুদ্র ও পাইকার ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত টাকায় ইজারা নেওয়ার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছে না। তারা বলছে এ অবস্থায় অতিরিক্ত খাজনা আদায় কৃষক, ব্যবসায়ী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ক্রয় করতে হবে অতিরিক্ত মূল্যে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের নিমসার এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহৎ এই সবজি বাজারটির অবস্থান। বাজারটির কিছু অংশ সরকারি জায়গায় থাকার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বিশাল এলাকাসহ প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কের দুই পাশজুড়ে অবস্থান। বাজারে তিন শতাধিক পাইকার আড়তের সঙ্গে পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র স্থানীয় প্রান্তিক চাষি বেচা-কেনা করেন। রাত যত গভীর হয়, এই বাজারের ব্যস্ততা তত বাড়তে থাকে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের ব্যস্ততাও কমে যায়।
বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত যেমনÑ রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, যশোহর, নাটোর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মৌসুমি শাকসবজি, দেশীয় ফল ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানযোগে পাইকার কখনও বা কৃষক সরাসরি বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। একইভাবে কুমিল্লার দাউদকান্দি, চান্দিনা, মুরাদনগর, দেবিদ্বার, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, আদর্শ সদর, লালমাই, বরুড়া, সদর দক্ষিণ উপজেলা থেকেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শাকসবজি, মৌসুমি ফলসহ অন্যান্য তরকারি নিয়ে আসে বিক্রির জন্য।
সরেজমিন বাজার ঘুরে একাধিক পাইকার ও ক্ষুদ্র প্রান্তিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের ইজারাদার প্রতিটি বিক্রেতার কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খাজনার অতিরিক্ত আদায় করছে। পূর্বেও এই প্রক্রিয়া থাকায় বিগত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বাজারে অভিযান চালিয়ে খাজনা আদায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এ সময় পণ্যের মূল্য বা বাজারে চাহিদা দেখে পাইকারি বা চাষিদের অর্থাৎ বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে দেখা যায় ইজারাদারের লোকজনদের।
একইভাবে স্থানীয় ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের থেকেও অস্বাভাবিক খাজনা আদায় করে। মহাসড়কের কুমিল্লাগামী অংশে সড়কের পাশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক, পালংশাক, মুলা, লালশাক, পেপে, ফুলকপি ও বাধাকপি, আলু নিয়ে বসছেন ১৫-২০ জন কৃষক। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, সরকারি জায়গা (সড়ক ও জনপথের) খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছি। এখানেও ইজারাদারের লোকজন কখনও সংখ্যা, কখনো পণ্যের মুঠা গুণে টাকা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ছোট আকারের ১০০ মুঠা শাক থেকে ৩০০-৪০০ টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এতে কাঙ্ক্ষিত লাভ হচ্ছে না।
একইভাবে ২৩-২৪ কেজি ওজনের টমেটোর ঝুড়ি থেকেও গড়ে ৫০ টাকার বেশি খাজনা নিচ্ছে। এ ছাড়া যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ অপেক্ষাকৃত কমÑ সেসব ব্যবসায়ী বা আড়ৎদারদের কাছ থেকেও যেমন খাজনা নিচ্ছে, তেমনি আড়ৎ থেকে কিনতে আসা ব্যাসায়ীদের কাছ থেকেও নিচ্ছে টাকা। মোট কথা স্থানীয়সহ সারা দেশ থেকে নিয়ে আসা পণ্যের মালিকদের যেমন খাজনা দিতে হচ্ছে, তেমনি এই বাজার থেকে ক্রয় করে জেলা ও জেলার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন হাটবাজারে ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, মিনিট্রাক, ট্রাক, রিকশাভ্যান, কাভার্ড ভ্যানে নেওয়ার সময়ও খাজনা দিতে হয়। অর্থাৎ এই বাজারে একটি পণ্যে থেকে দুদফা খাজনা নিতে দেখা যায়। এতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। পরবর্তিতে যার প্রভাব পড়ে স্থানীয় খুচরা বাজারে।
অভিযোগ রয়েছে, এভাবে অস্বাভাবিক মূল্যে ইজারা নিয়ে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী একটি চক্র বাজারটির পণ্যের মূল্য অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। এবারেও একইভাবে আগের সুবিধাভোগী চক্রের লোকজন অতিরিক্ত মূল্যে ইজারা নিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে জানান, খাজনা আদায়ে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। প্রতিটি আড়ৎ বা ছোট ব্যবসায়ীদের ঘর বা বিটপ্রতি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে একটা অর্থ ধার্য করে দিলে কৃষক ও পাইকার বা মধ্যস্বত্বভোগীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারত।
ইজারাদার আব্দুল জলিল বলেন, অতীতে কী হয়েছে, সেটা বলতে পারব না। তবে এবার আমরা ব্যবসায়ী ও কৃষকদের কথা চিন্তা করে ‘সহনীয়’ মাত্রায় খাজনা আদায় করব। অতিরিক্ত খাজনা নেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে ইউএনও সাহিদা আক্তার জানান, বড়, মাঝারি, ছোট বা প্রান্তিক ব্যবসায়ী বলতে কোনো কিছু নেই। পণ্যের ওপর টোল নির্ধারণ করা হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত নতুন কোনো সরকারি নির্দেশনা আসেনি।