আরেফিন লিমন, গলাচিপা (পটুয়াখালী)
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৫ ১২:৫৩ পিএম
পটুয়াখালীর গলাচিপার বোয়ালিয়া গ্রামের কৃষকরা আলু উত্তোলনের পর মাঠেই স্তূপ করে রেখেছেন। মঙ্গলবার তোলা। প্রবা ফটো
আলু বেচার পর কৃষিকাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না বোয়ালীয়া গ্রামের কৃষকরা। কারণ আলু বেচে বিনিয়োগই উঠে আসছে না। আলুর দাম কম হওয়ায় দিশাহারা গলাচিপার কৃষকরা। তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আলুর ভালো ফলন হলেও সঠিক দাম পাচ্ছে না কৃষক।
বাজারে আলুর দাম কম হওয়ায় তা রেখে দিয়ে সুবিধামতো বেচে লাভবান হবে কৃষক তারও কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফলে ক্ষেত থেকেই পাইকারদের কাছে কম দামে আলু বেচতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। কেউ কেউ আবার আলু জমাট করে রাখতে টাল তৈরি করেছেন। কেউ-বা গাছ কেটে মাটির নিচে সংরক্ষণ করছেন। কিন্তু তাতেও ভয় কাটছে না। আবহাওয়া প্রতিকূল হলে হাজার হাজার মণ আলু ক্ষেতেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গলাচিপায় আলু চাষের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে। প্রথমদিকে ভালো ফলন ও লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। উপজেলার মুরাদনগর, বোয়ালীয়া ও চরখালী গ্রামে সবচেয়ে বেশি আলুর চাষ হয়। এ বছর উপজেলায় ৩৭০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার (৩৬৫ হেক্টর) চেয়ে বেশি। প্রতিটি হেক্টর জমিতে ২৮ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এতে চাষিদের উৎফুল্ল হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা হয়নি। কারণ ক্রেতা নেই। সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নেই। এ অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছে পাইকাররা। ফলে পাওয়া যাচ্ছে না ন্যায্য দাম।
উপজেলার সেলিম নামের এক কৃষক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকের কাছে হিমাগার স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। সেলিম বলেন, ‘যদি হিমাগার থাকত, তাহলে আমাদের এই দুঃসময় দেখতে হতো না। আলু সংরক্ষণ করে ভালো দামে বেচতে পারতাম।’ মুরাদনগর গ্রামের আবু সালেহ এ বছর ৪০ কড়া জমিতে আলু চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি কড়ায় ৫,৫০০ টাকা খরচ হলেও ফলন হয়েছে ৮/১০ মণ। প্রথমদিকে পাইকাররা ৬৯০ টাকা মণ দরে কিনলেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম নেমে এসেছে ৬০০ টাকায়।’ একই গ্রামের রেজাউল করিম, শামীম হাং, রহমান হাং ও মিলন মিয়া বলেন, ‘দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষেতেই আলু রেখে দিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা, ন্যায্য দাম না পেলে পরের মৌসুমে কেউ আর আলু চাষে আগ্রহী হবেন না।’
উত্তর চরখালী গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন ৮০ কড়া জমিতে আলু চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘লাভ তো দূরের কথা, পুঁজি উঠে আসাই কঠিন হয়ে পড়বে। এখনও ক্ষেত থেকেই আলু তুলতে পারিনি।’
এদিকে উপজেলার আলুক্ষেতে শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকই বেশি। মিতু বেগম, লিজা আক্তার, শাহিনুর বেগম ও রিনা বেগম প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু পুরুষদের সমান পরিশ্রম করেও তারা মজুরি পান অর্ধেক। পুরুষ শ্রমিকরা যেখানে ৬০০ টাকা পান, সেখানে নারীরা পান ৩০০ টাকা। নারীশ্রমিক মিতু বেগম বলেন, ‘আমরা সমান কাজ করে মজুরি অর্ধেক, এটা কি ঠিক? রোজার দিনে এত কাজ করেও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছি না।’ গলাচিপার কৃষি কর্মকর্তা আরজু আক্তার বলেন, ‘আলু একটি সবজি, এটি আগাম চাষ করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন। বোয়ালীয়ার কৃষক মোশারেফ চকিদার পাশের উপজেলায় ১০০ মণ আলু বিক্রি করে ২০ হাজার টাকা লাভ করেছেন বলে জানান। এ কৃষি কর্মকর্তার মতে, ‘যদি কৃষকরা ধৈর্য ধরে সঠিক পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন, তাহলে তারা লাভের মুখ দেখবেন।
তবে কৃষকদের একটাই দাবি গলাচিপায় জরুরিভিত্তিতে হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। হিমাগার নির্মাণ করা হলে স্থানীয় কৃষকরা লাভবান হবেন। লোকসানের হাত থেকে বাঁচবেন তারা। যে উদ্যম নিয়ে তারা আলু চাষ করছেন, এতে আরও আন্তরিকতা ঢেলে দেবেন। ফলে গলাচিপার কৃষকের আলু দেশব্যাপী সরবরাহধারা অক্ষুণ্ন রাখবে। গলাচিপার হাজারো কৃষক এখন একটাই দাবি তুলেছেনÑ আলুর ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে, সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। যদি এসব ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামীতে অনেক কৃষক আলু চাষ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবেন। কৃষকদের প্রশ্ন, ‘সার, বীজ, শ্রমিক সবকিছুর দাম বাড়ছে, তাহলে আমাদের উৎপাদিত ফসলের দাম কমছে কেন?’ কৃষকরা আশাবাদী এই সংকট সমাধানে প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে। হিমাগার তৈরি করবে।