কিশোরগঞ্জ
সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৫ ২০:৫০ পিএম
কিশোরগঞ্জে ইফতারের দাম বেড়েছে। ইফতার সামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় ইফতারের নানা মজাদার আইটেম পড়েছে টান পড়েছে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের পকেটে। ফলে সাধারন মানুষ মজাদার ইফতার খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ইফতারির আইটেম থেকে বেগুনি, জিলাপি, হালিমসহ অন্যান্য মজাদার খাবার বাদ পড়ছে। প্রথম রোজাতেই প্রয়োজনীয় ও মজাদার ইফতার সামগ্রী না পেয়ে পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করছে। পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা জানান, খেজুর, ছোলা, ময়দা, চিনিসহ ইফতারির পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ফলের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গত রোজায় সবোর্চ্চ ১১০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিনি এখন ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ৪৫০ টাকার খেজুরের দাম বেড়ে হয়েছে ৭৫০ টাকা। ৬৫ টাকা কেজির ময়দার দাম এখন ৮০ টাকা। ইফতারি পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা অস্বস্তিতে আছেন। এই বাস্তবতায় বাধ্য হয়ে তারা ইফতারির আইটেম পাতে দিতে পারছেন না। আবার সারাদিন রোজা রেখে কম আইটেমে সন্তোষ্ট হতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
কিশোরগঞ্জ ইফতার বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ১০ টাকার পেয়াজু ২০ টাকা, ১২০ টাকার ছোলা ১৫০ টাকা, ৩৮০ টাকার রেশমি জিলাপি ৪৪০ টাকা কেজি, ১৮০ টাকার বোম্বে জিলাপি ৩২০ টাকা, গুড়ের ২৮০ টাকার জিলাপি ৩২০ টাকা, ২৮০ টাকার শাহী হালিম ৩৫০ টাকা, ২০ টাকার জালি কাবাব ৩০ টাকা, ৩০ টাকার টিক্কা কাবাব ৪০ টাকা, ২০ টাকার শামী কাবাব ৩০ টাকায়, ডিম চপ (হাফ) ২০ টাকা, ৫৫ টাকার সাসলিক ৮০ টাকায় ১১০ টাকার চিকেন তান্দুরী ১৪০ টাকায়, ১২০ টাকার বিবিকিউ ১৫০ টাকায়, ১০০ টাকার চিকেন ফ্রাই ১৫০ টাকা, ৮০ টাকার গ্রীল ১১০ টাকায়, ৬০ টাকার চিকেন চাপ ৮০ এবং স্পেশালটি চাপ ১৩০ টাকা, ১৮০ টাকার বুন্দিয়া ২৫০ টাকা ১৬০ টাকার বোরহানি ২৫০ টাকায় ২৫০ টাকার খাশির তেহারী ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় ইফতারির বাজারে গিয়ে ক্রেতারা হিসেব মিলাতে পারছে না। ১০টি ইফাতার আইটেম না কিনে দাম বেশি হওয়ায় ৫টি কিনছেন। ফলে প্রথম রোজা থেকেই নেই নানা ধরণের মাজাদার ইফতার সামগ্রী। আবার পরিবারের কেউ কেউ বায়না ধরতে বিশেষ আইটেম নিয়ে।
এ অবস্থায় সদস্যদের বায়না মিটাতে না পেরে সিংহভাগ মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাতাশায় আছেন। সামনে ঈদের জামা-কাপড় তো রয়েছেই। শহরের খরমপট্রি এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবুল হাসান বলেন, ‘পেয়াজসহ সবজির দাম গত বছরের তুলনায় কম। তারপরও ইফতার সামগ্রীর দাম বাড়ায় তিনি হতাশা।’
শহরের অভিজাত গাংচিল রেস্তারায় ইফতার সামগ্রী কিনতে এসেছেন ব্যাংকার মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। আবার ইফতার সামগ্রী দামও চড়া। তাই এবার প্রথম রোজা থেকে দিন টিক্কা কাবাব, চিকেন তান্দুরী ও বোরহানী বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি। এতে আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা মন খারাপ করছে। তারপরও করার কিছু নেই নিম্নবিত্তদের। কারণ রুজি কমে যাওয়ায় তাদের হাতে টাকা নেই। পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সংসার খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ মধ্য ও নিম্নবিত্তরা। তাই সব পেশার মানুষ ইফতারির আয়োজনে কাট-ছাট করতে বাধ্য হচ্ছে।’
স্টেশন সড়কের জয়কালী রেস্টুরেন্টে এসেছেন গৃহিণী ইফতার বানু। ইফাতার পণ্যেও দাম দেখে তিনি রীতিমতো বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি চাকরি। মাস শেষে যা বেতন পাই তা দিয়ে মাস কোনওভাবে চলে যায়। এবার ইফাতারির সাধারণ আইটেম ছোলা, বেগুনি, চপ, জিলাপী, কাবাব ইত্যাদির দাম দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধুমাত্র খেজুর আর ছোলা-মুড়ি দিয়ে ইফতারি করবো। তাই ৮০/১০০ টাকা কেজি দামে মুড়ি আর ২০/২৫ টাকার ছোলা কিনে বাড়ি ফিরছি। মজাদার ইফাতার আইটেম কম বেতনের চাকুরীজীবীদের কপালে নেই।’ এছাড়া এবারের ইফতারিতে কোনও ফল রাখা সম্ভব নয় বলেও তার অভিমত।
স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত সুমন মিয়া বলেন, ‘ইফতার বাজারে গিয়ে দাম ও মান দেখে সন্তোষ্ট হতে পারেনি। কারণ ব্যবসায়ীরা সবকিছুতেই বেশি লাভ করতে চায়। আমার আর্থিক সাধ্যও নেই। তাই এবারের ইফতারিতে বেশ কয়েকটি আইটেম বাদ দিতে হয়েছে। বিশেষ কওর মাংস জাতীয় সব কয়টি আইটেম বাদ দিয়েছি। ফলসহ মজাদার আইটেম এবার আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ও কেটে খাওয়া মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই সামান্য আয়োজনে ইফতার সাজিয়েছি।’
শহরতলি কলাপাড়া গ্রামের রিকশাচালক ইদু মিয়া বলেন, ‘ডাল-ভাতের দাম যেভাবে বেড়েছে তা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। বুধবার (১২ মার্চ) যাত্রী না থাকায় সকাল থেকে ৩০০ টাকার কাজও হয়নি। রাতের জন্য চাল-ডাল কিনে আমাদের মতো রিকসাচালকদের ইফতারি কেনা চুরি করা ছাড়া উপায় নেই।’ কেটে খাওয়া গরিব মানুষদের ছোলা-মুড়ির মধ্যেই ইফতারি সীমাবদ্ধ থাকবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘আজ ( বুধবার ১২ মার্চ) ৩০০ টাকা আয় করেছি। তাই রাতের খাবার কিনে আজ শুধু ভাত খেয়েই ইফতারি করতে হবে।’
বড় বাজারের জিলাপির দাকোনে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘একটি হাসপাতালে কাজ করে যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য ইফতারিতে ফলসহ অনেক কিছুই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই কাবাব ও শাহী জিলাপির স্বাদ সপ্তাহে দুইদিন নিতে হবে। এভাবে রুটিন করেই ইফাতার সামগ্রীর মাসব্যাপী তালিকা করে বাজার করছি। ইফতারে কোনও ফলের আইটেম আপাতত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বোনাস পাওয়ার পর ফলের আইটেম রাখার চিন্তা ভাবনা রয়েছে।’
প্রাথমিক বিদালয়ের শিক্ষক সামিউল হক বলেন, ‘বাজারে নানা ধরনের শরবত আইটেম রয়েছে। সবগুলোর দাম আকাশচুম্বি। তাই এবার তার ইফাতার আইটেমে মাংস জাতীয় সবগুলো বাদ থাকবে। বাজারে জনপ্রিয় শরবত বাদ দিয়ে এবার লেবু শরবত থাকবে ইফাতার আইটেমে।’
গাংচিল রেস্তারায় মালিক আবু সাঈদসহ একাধিক রেস্তারার মালিক বলেন, ‘তারা বাজার থেকে ইফাতার সামগ্রীর কাচামাল কিনে আইটেম তৈরি করেন। পরে সামান্য লাভ ধরে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এবার সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। তাই আইটেমের দাম এমনিতেই বেড়ে গেছে। আমাদের প্রধান ক্রেতা সাধারণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। এবার তাদের হাতে টাকা না থাকায় বেচা-বিক্র প্রথম দিনে থেকেই কম। অনেক আইটেম থেকে যাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলোতে কম করে ইফাতার আইটেম তেরি করবো। তাছাড়া খুব কম লাভে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করছি। বলতে দ্বিধা নেই। সারা মাসের লাভ একদিনের জরিমানায় সব শেষ হয়ে যায়।’