এমএ হান্নান, বাউফল (পটুয়াখালী)
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫ ১২:১৬ পিএম
বাউফলের মদনপুরের পালপাড়া গ্রামে কাজ করছেন মৃৎশিল্পীরা। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
পটুয়াখালীর বাউফলের মাটির পণ্যের সুখ্যাতি দীর্ঘদিনের। যুগ যুগ ধরে এ উপজেলার পাল বংশের মানুষ গৃহস্থালির বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করে আসছে। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হতো। আদি এই পেশায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। দক্ষ কারুশিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নানা শৈল্পিক পণ্য, যা দেশেই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
একসময় গৃহস্থালির কাছে থালা-বাসন, হাঁড়ি-কলস, পাতিল, বদনা, মটকাসহ বিভিন্ন তৈজস পণ্য তৈরি হতো। প্লাস্টিক, মেলামাইন ও ধাতব পণ্যের ভিড়ে ছিটকে পড়ে। বাপ-দাদার পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে মাটির পণ্য তৈরিতে আধুনিকায়ন করে পাল বংশের নতুন প্রজন্ম। তারা মাটির পণ্যে এনেছেন নান্দনিকতা। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চুল্লি, বৈদ্যুতিক চাকা, মাটির মিশ্রণ যন্ত্রে এনেছেন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া।
উপজেলার মদনপুরা এলাকার পালপাড়া ঘুরে জানা গেছে, শহুরে মানুষ ও উন্নত বিশ্বের চাহিদা মাথায় রেখে নিত্যনতুন নকশাও করেছেন। তৈরি করছেন আধুনিক সব ব্যবহারের পণ্য। তার সঙ্গে তৈরি করছেন ফুলদানি, মোমদানি, কলম দানি, হারিকেনসহ নানা রকমের শোপিস। মনীষীদের ভাস্কর্যসহ নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ নানা শিল্পকর্ম।
১৭৫৬ সালে ভারত বর্ষে মুঘল শাসন চলছিল। তখন মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর সিরাজউদৌলা নবাব হন। নবাব সিরাজউদৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে বাংলায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি। খুলনা অঞ্চলেও এর প্রভাব পরে। যে কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রূপ কুমার পাল ও মোহন চাঁদ পাল নামে দুই ভাই দুটি নৌকায় তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলে চলে আসেন।
বর্তমান মদনপুরা ইউনিয়নে আলোকি নদীর পাড়ে তারা বসতি গড়ে তোলেন। তারা মাটির থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল, জালের চাকা তৈরি করতেন। এ অঞ্চলের মানুষ তাদের কাছ থেকে এসব মাটির জিনিস কিনে নিতেন। সময়ের পরিক্রমায় তারা মানুষের প্রয়োজনে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে থাকেন। শত বছর পরেও উত্তরসূরিরা তাদের আদি পুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। সময়ের চাহিদা মেটাতে এ মৃৎশিল্প আধুনিকায়ন হয়। এখন এখানে ২০টি পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ করছে। পারিবারিকভাবে অনেকে মৃৎশিল্পের পণ্য তৈরি করে থাকেন। কয়েকটি কারখানাও রয়েছে। সেখানে শতাধিক কারুশিল্পীরা কাজ করে থাকেন।
উপজেলার মদনপুরা ও কনকদিয়া ইউনিয়নের পালপাড়া গিয়ে দেখা যায়, মাটির পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। সেখানে চোখে পড়েছে মাটির তৈরি বাহারি সব তৈজসপত্র। শোনা যায় নানা রঙবেরঙের খেলনার টুংটাং শব্দ। বাহারি ডিজাইনের পণ্য ফিনিশিং শেষে চলছে প্যাকেজিং। কাগুজিরপুল ব্রিজের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে লোড করা হচ্ছে মাটির তৈরি পণ্যভর্তি ঝুড়ি। বাজার ধরতে গাড়িগুলো যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
মাটির পণ্যে একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্বেশ্বর পাল জানান, এখানকার মাটির পণ্য দেশ-বিদেশে নন্দিত। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য আড়ং, কোর দি জুট ওয়ার্কস, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তিনি বলেন, প্লাস্টিক পণ্যের প্রভাবে বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা এই পেশা যখন বিলুপ্তির পথে তখন আধুনিক ডিজাইনের পণ্য তৈরির কৌশল নেই। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর সব মাটির পণ্যেই নতুনত্ব এসেছে। এসব কারখানা থেকে মাসে প্রায় কোটি টাকার পণ্য যায় ঢাকার আড়ং, ঢাকা হ্যান্ডি ক্রাফটস এবং কারিতাসের প্রকল্প কো দ্য জুটওয়ার্কে।
মৃৎশিল্পী আশিষ চন্দ্র পাল জানান, প্রতিবছরই পণ্যের ডিজাইনে পরির্বতন আসে। ঢাকার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নতুন ডিজাইন করে তাদের চাহিদাপত্র দেন। সে অনুযায়ী নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য তৈরি হয়। মাটির তৈরি পণ্যসামগ্রী এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার ও অস্ট্রেলিয়ার বাজার দখল করেছে।
মৃৎশিল্প কারখানার মালিকরা জানান, মাটির তৈরি পণ্য প্যাকেট করে নুরাইনপুর লঞ্চঘাটে যায়। সেখান থেকে লঞ্চযোগে ঢাকায় নেওয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন মেলা কিংবা স্টলে এসব পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া ট্রাকে করেও ঢাকায় যায়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন কোম্পানি মাটির তৈরি পণ্য বিমানে করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়।
পটুয়াখালী বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) আলমগীর সিকদার বলেন, বাউফলের মাটির পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বিসিক সব সময় তাদের পাশে ছিল। ঋণ সহায়তাসহ দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।