হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৫ পিএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
জ্বালানি তেল আমদানির জাহাজ ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে ভাড়ার টাকা দেওয়া হলেও ডলারের দামের তারতম্যের কারণে দুই জাহাজেই বিএসসিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।
গত বছরের মার্চ মাসে প্রতি ডলার ১১০ টাকা হারে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা একটি মাদার ট্যাংকারের ভাড়া বাবদ বিএসসিকে ৫৭ কোটি ২৬ লাখ ৮১ হাজার ৭৬১ টাকা প্রদান করে বিপিসি। সে অনুযায়ী ওই জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিএসসিকে কিছু ডলার কিনতে হয় ১১৭ টাকা দরে। এতে বেড়ে যায় খরচ।
জাহাজটির ভাড়া ৫২ লাখ ৬ হাজার ১৯৭ ডলার পরিশোধ করতে গিয়ে বিএসসিকে খরচ করতে হয় ৫৮ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৫ টাকা। এই হিসাবে ওই জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে বিএসসিকে নিজস্ব তহবিল থেকে বাড়তি খরচ করতে হয় এক কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার ১৩৪ টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজের ভাড়া বাবদ খরচ হওয়া বাড়তি টাকাটা দেওয়ার দায়িত্ব বিপিসির হলেও সেই সুযোগ নেই প্রতিষ্ঠানটির হাতে। কেননা টাকা প্রদানের সময়ে থাকা ডলারের সরকার নির্ধারিত দরে বিপিসি জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করে থাকে। ফলে ডলারের বর্ধিত দামের কারণে বাড়তি ব্যয়টা বিএসসিকেই বহন করতে হচ্ছে।
শুধু এই জাহাজটির ভাড়া পরিশোধ করার সময় নয়, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রায় সময়ই এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে বিএসসি। এতে বিপিসির আমদানি করা জ্বালানি তেল পরিবহনে প্রায় সময় লোকসান দিতে হয় বিএসসিকে।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মাঝামাঝিতে দুটি জাহাজের পেছনে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭১ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। আমদানি করা ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা দুটি মাদার ট্যাংকার জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে ডলারের দামের তারতম্যের কারণে বিএসসিকে এই বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হয়। এর মধ্যে মে মাসে একটি জাহাজের ভাড়া বাবদ বাড়তি পরিশোধ করতে হয় এক কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার ১৩৪ টাকা। জুন মাসে অন্য একটি মাদার ট্যাংকার জাহাজের ভাড়া বাবদ বাড়তি পরিশোধ করতে হয় চার কোটি ২০ লাখ ৬ হাজার ৫৩৭ টাকা।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন ২০১৯ সংশ্লিষ্ট বিধিমালা-২০২৩ এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় চার্টারিং কমিটির গ্রাউন্ড রুল অনুযায়ী, বিপিসির পক্ষে বিএসসি প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মাদার ট্যাংকার জাহাজ ভাড়াকরণপূর্বক ক্রুড অয়েল পরিবহন করে আসছে। চার্টার পার্টি অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী জাহাজ মালিকের ভাড়া ইউএস ডলারে পরিশোধ করার দায়-দায়িত্ব বিপিসির ওপর বর্তায়।
বিপিসির সঙ্গে বিএসসির দীর্ঘ বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বিবেচনায় মাদার ট্যাংকারের ভাড়া স্থানীয় মুদ্রায় প্রাপ্তির পর বিপিসির পক্ষে বিএসসি ওই ভাড়া ইউএস ডলারে বিদেশি জাহাজ কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক বিএসসির নিজস্ব জাহাজ পরিচালনা আয় থেকে পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ইউএস ডলার তহবিল থেকে বিপিসির মাদার ট্যাংকার জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করা হয়। পাশাপাশি বিএসসির নিজস্ব তহবিলে পর্যাপ্ত ইউএস ডলার না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার প্রাপ্তি সাপেক্ষে এডি ব্যাংকের মাধ্যমে ফ্রেইট পরিশোধ করা হয়।
তবে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গেলেই বিপাকে পড়তে হয় বিএসসিকে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝিতে দুটি জাহাজের ভাড়া বাবদ প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছরের ১ এপ্রিল জাহাজ মালিকের ভাড়া পরিশোধ করার জন্য বিএসসির অনুমোদিত ডলার ব্যাংক (বেসিক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা) কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার সরবরাহের চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যথাসময়ে ডলার সরবরাহ করা হয়নি। পরবর্তীতে ডলারের বিনিময় হার সরকারিভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রতি ডলার ১১০ টাকার পরিবর্তে ১১৭ টাকা দরে কিনতে হয় বিএসসিকে।
একইভাবে ২৯ এপ্রিল আরেকটি জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করার জন্য বেসিক ব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার সরবরাহের চাহিদাপত্র পাঠানো হলে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে ডলার সরবরাহ করতে পারেনি। পরবর্তীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পর প্রতি ডলার ১১০ টাকার পরিবর্তে ১১৮ টাকা দরে কিনতে হয়। এতে দুই জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে বিএসসিকে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭১ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।
এ সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (অর্থ) মো. আব্দুল মতিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশকে কল করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ডলার চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক সময় চাহিদামতো তা সরবরাহ করতে পারে না। তখন বাইরের মার্কেট থেকে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছু বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনতে হয়। কিন্তু বিপিসি তো আমাদেরকে সরবরাহ করে সরকারি দরে। তখন বাড়তি টাকাটা আমাদেরকে বহন করতে হয়। আমাদের প্রতি মাসে প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা বেশি গেলেও অনেক টাকা হয়। ডলারের দাম যদি ৫-৭ টাকা বেড়ে যায়, তখন তো লোকসান আরও বেশি হয়।’
তবে বিষয়টি নিয়ে বিপিসিরও কিছু করার নেই মন্তব্য করে মাহমুদুল মালেক বলেন, ‘ডলারের দামের তারতম্যের কারণে যেই বাড়তি টাকা খরচ হয় এটি নিয়ে বিপিসির করার মতো কিছু থাকে না। কারণ তারা তো সরকার নির্ধারিত দরে আমাদের ডলারের মূল্য পরিশোধ করে। সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দিতে গেলে বিপিসিকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তারপরও ডলারের দামের তারতম্যের কারণে যেহেতু আমাদের লোকসান হচ্ছে, সেজন্য আমি বিষয়টি বিপিসি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আমরা দুপক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে আমরা একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব।’