মহেশখালী (কক্সবাজার) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৯ পিএম
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:২১ পিএম
আদিনাথ মন্দির। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপ মহেশখালীর ঐতিহাসিক আদিনাথ মন্দিরে আজ বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হলো শিব চতুর্দশী পূজা ও মেলা। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মহাদেবের আশীর্বাদ লাভের আশায় এই মন্দিরে সমবেত হন।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাহুল চক্রবর্তীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মূল পূজার লগ্ন নির্ধারিত হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ১১ মিনিটে। যা আগামীকাল ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত চলবে। তবে পূজা-অর্চনার মূল পর্ব শেষ হলেও ভক্তদের জন্য আরও তিন দিনব্যাপী বিশেষ দর্শন ও উপাসনার ব্যবস্থা থাকবে।
গতকাল মঙ্গলবার থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুণ্যার্থীরা মহেশখালীর মৈনাক পর্বতের পাদদেশে আসতে শুরু করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতি বছরের মতো এবারও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়া থেকে অসংখ্য ভক্ত ও পর্যটক এ মেলায় অংশ নিতে এসেছেন। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে আসা এ মেলা লোকজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক অনন্য মিলন মেলায় পরিণত হয়।
শিব চতুর্দশী পূজা ও আদিনাথ মেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. হেদায়েত উল্যাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভক্তদের নির্বিঘ্নে পূজা-অর্চনা ও মেলা উপভোগের সুযোগ দিতে আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালিয়ে যাব।
এদিকে এ মেলাকে ঘিরে গত ১০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আদিনাথ মন্দির কমিটির সদস্যদের নিয়ে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বছর মেলা পরিচালনার জন্য একটি বিশদ উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাতে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি পরিমল কান্তি শীল প্রধান উপদেষ্টা এবং মহেশখালী থানার ওসি কায়সার হামিদ মেলা সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
রশিদ নামে এক মুসলিম দর্শনার্থী, বলেন— ‘আমি ছোটবেলা থেকে আসছি। এখানে ধর্মের ভেদাভেদ নেই। সবাই একসাথে আনন্দ করে। মেলার জিলাপি না খেলে তো আসাটাই বৃথা! বস্তুত, আদিনাথের মিঠাইর জিলাপি মেলার এক নিজস্ব ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বটমূলের ছায়ায় বসে জিলাপি আর চা খেতে খেতে দর্শনার্থীরা হারিয়ে যান মৈনাকের রহস্যময় বাতাসে।’
এছাড়া, বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা কমিটি, দোকান ব্যবস্থাপনা ও টোল আদায় কমিটি, অর্থ ও ব্যয় তদারকি কমিটি, স্বাস্থ্যসেবা কমিটি, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কমিটি, আপ্যায়ন কমিটি ও সাজসজ্জা-পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শিব চতুর্দশী পূজা ও মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে পুলিশ, আনসার ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল। মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও মেলা সুপার কায়সার হামিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভক্ত ও দর্শনার্থীদের নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনের জন্য পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি মেলায় যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ভ্রাম্যমাণ টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তার বাইরেও, মেলা উদযাপন কমিটির পক্ষ হতে প্রায় ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে।’
এ মেলায় ধর্মীয় উপাসনার পাশাপাশি বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী লোকজ পণ্যের স্টল বসে, যেখানে দেশিয় হস্তশিল্প, প্রসাধনী, পোশাক, খাদ্যদ্রব্য এবং কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র বিক্রি হয়। এছাড়া, শিশু-কিশোরদের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচসহ নানা বিনোদনমূলক আয়োজনও রয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য শিব চতুর্দশী পূজা যেমন এক ধর্মীয় আবেগের উৎসব, তেমনি এটি বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের শৃঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আদিনাথ মন্দিরের শোভা আর পূজার ঘণ্টাধ্বনি যেন কয়েক শতকের পুরনো এক আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করে, যা ভক্ত-পর্যটকদের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে ৪ মার্চ পর্যন্ত, যেখানে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন মহাদেবের চরণে।