নাপা ছাড়া ক্লিনিকে কিছুই পাওয়া যায় না
রাসেল মাহমুদ,বরগুনা
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:০৯ পিএম
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৪ পিএম
২০০০ সালে আমতলী উপজেলার চালিতাবুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে চিকিৎসাসেবা বন্ধ ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। প্রবা ফটো
প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বরগুনা জেলায় ১২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে; যা এখন ত্রিমুখী সংকটে ধুঁকছে। অধিকাংশ ক্লিনিকের ভবনগুলোর জরাজীর্ণ ও বেহাল দশা, চাহিদার তুলনায় কম ওষুধ সরবরাহ থাকা এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) বা স্বাস্থ্যকর্মীরা অনিয়মিত যাতায়াত করায় দেখা দিয়েছে এই সংকট।
দেশের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৯৯৯ সালে সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। ২০০১ সালে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থল সেই ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি আবারও চালু হয়। এরপর দ্রুত কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুসারে, বরগুনা জেলায় ১২৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে; যার মধ্যে উচ্চ ঝুকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ৩৬টি, মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ২৮টি, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ১৯টি। তার মধ্যে বরগুনা সদর ২২টি, আমতলী ১৪টি, তালতলী ৫টি, পাথরঘাটা ১৯টি, বেতাগী ১৩টি, বামনা ৭টি।
প্রতিটা ক্লিনিকে একজন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার( সিএইচসিপি) বা কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে; যারা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য চাহিদায় কাজ করে। বিশেষ করে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করার জন্য বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়।
এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করার কথা। তবে অযত্ন-অবহেলা, অনিয়ম আর জরাজীর্ণ ভবনের কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে জেলার ১২৪টি ক্লিনিকের সবগুলোতেই সিএইচসিপি রয়েছেন। প্রতিটি ক্লিনিক সপ্তাহে ৬ দিন খোলা থাকার কথা এবং সিএইচসিপির পাশাপাশি ৩ দিন করে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার পরিবার পরিকল্পনা সহায়কের সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা। তবে বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
সম্প্রতি বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ করুনা কমিউনিটি ক্লিনিকসহ কয়েকটি ক্লিনিকে দেখা গেছে, সেগুলো তালাবদ্ধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা সপ্তাহে ২/৩ দিনের বেশি আসেন না। সকাল ১০-১১টায় এলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান।
চরদুয়ানী গ্রামের বাসিন্দা গৃহিনী মমতাজ বেগম বলেন, দুপুর না হতেই তো ক্লিনিক বন্ধ হইয়া যায়। সেবা নামে হয়রানি চলে। ক্লিনিকে আসলে নাপা ছাড়া কিছু পাই না।
কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সেবাপ্রত্যাশী নারীদের ভিড়। সেখানে সিএইচসিপির কাছে সমস্যার কথা বলে ওষুধপত্র নিচ্ছেন তারা। তবে সংকটের কারণে মাসের শেষের দিকে ওষুধ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তাদের।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের তথ্য অনুসারে, প্রতি মাসে ২৭ প্রকার মেডিসিন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পেয়ে থাকে; যার মধ্যে নাপা, এন্টাসিড,কৃমিনাশক, পাপায়া (কোষ্ঠকাঠিন্য) দূর করে। সালবুটামল( হাঁপানি এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ), ভিটামিন, খাবার স্যালাইন, জিংক সিরাপ এছাড়া বাচ্চাদের কিছু রোগের সিরাপ।
আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়ানের ছোনাউঠা কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার স্বর্ণা বলেন, ক্লিনিকে ২৭ প্রকারের ওষুধ দেওয়া হয়। ২ মাসের জন্য সেগুলো দেওয়া হলেও তা ৬ হাজার মানুষের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এজন্য মাসের শুরুতেই তা শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চাদের সর্দি-জ্বর ও পাতলা পায়খানার সিরাপের চাহিদা বেশি থাকলেও তা পরিমাণে কম পাওয়া যায়। বরাদ্দ আর একটু বাড়ালে আমাদের জন্য ভালো হতো।
পাথরঘাটার কাঠালতলী ইউনিয়ানের ভালুকের চরদুয়ানীর স্থানীয় বাসিন্দা মুন্নি বলেন, ‘ভবন জরাজীর্ণ ঠিকমত বসার জায়গা নেই। ক্লিনিকে তো সময় মতো লোক পাওয়া যায় না। ওষুধ আনবার গেলে হুনি ওষুধ শেষ হইয়া গেছে। পরে বাধ্য হইয়াই উপজেলা হাসপাতালে যাই।’
আমতলীর গেরাধুনিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন মা ও শিশুকে সেবা প্রদান করে থাকি। কমিউনিটি ক্লিনিকটি জরাজীর্ণ অবস্থায় বেশ কয়েক বছর ধরে পড়ে আছে। যেখানে বসে নরমাল ডেলিভারি ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ছাদ দিয়া পানি পড়ে মাঝে মাঝে প্লাস্টারও খসে পড়ে।’
সচেতন নাগরিকের প্রতিনিধি মুসফিক আরিফ বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যর্থতা সরকার ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। সেবার নামে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে কেন না অধিকাংশ ক্লিনিকে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মী উপস্থিত থাকে না। পর্যাপ্ত ওষুধ ও জনবলের সুবিধা সরকার দেয় না। মানুষ তারপর বাধ্য হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়।
বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. প্রদীপ চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান আরও বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এতে সেবার মান আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে, আশা করছি সেবার মান আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, জেলার জরাজীর্ণ ভবনগুলো মেরামতযোগ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ- এ তিন ক্যাটাগরিতে তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি এ বিষয়েও শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বর্তমানে ওষুধের কোনো সঙ্কট নেই। তবে সরকার যদি বরাদ্দের পরিমাণ আরও বাড়ায়, তাহলে জনগণকে আরও বেশি পরিমাণে ওষুধ দেওয়া সম্ভব হবে।