সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:১৫ পিএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:১৮ পিএম
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের অদূরে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে (জেলখানা মোড়) বেদে পল্লী। প্রবা ফটো
‘মোরা একঘাটেতে রান্ধি বাড়ি আর এক ঘাটে খাই, পথে ঘাটে ঘুরে মোরা সাপ খেলা দেখাই, মোদের সুখের সীমা নাই’- এটি বেদে সম্প্রদায়ের কাছে অতি পরিচিত একটি গান। নাটক ও সিনেমাতেও বেদে সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার চিত্র ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে তাদের বিচিত্র সংগ্রাম। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার কথা আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। সমাজের মূলস্রোতধারা থেকে পিছিয়ে পড়া ওই জনগোষ্ঠীর কষ্টের জীবনচিত্র নিয়ে অতীতে বহু নাটক ও সিনেমা তৈরি হয়েছে।
সময়ের কালক্রমে বদলে গেছে যুগ, মানুষের গায়ে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে বেদে সম্প্রদায়ের জীবনে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। সভ্যতার এ যুগে আজও তারা যাযাবর জীবনযাপন করছেন। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রায় সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বেদেরা বঞ্চিত।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের অদূরে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে (জেলখানা মোড়) এলাকায় বেদে পল্লীর অবস্থান। খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করছেন ৩৪টি বেদে পরিবারের শিশু-নারীসহ প্রায় ৫৩ থেকে ৫৪ জন মানুষ। তবে স্থায়ী এ বেদে পল্লীটিতে এখনো পৌঁছায়নি শিক্ষার আলো। অবহেলিত এ বেদে সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য নেই আলাদা কোনো স্কুল-কলেজ। কোনো কোনো শিশু স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও অর্থের অভাবে শিশুর সেই ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন তার বাবা-মা।
সরকারিভাবে কোনো বাসস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় জেলখানা মোড় এলাকায় ছোট্ট একটি খোলা জায়গায় ‘খুপড়ি’ ঘর করে অনেকটা গাদাগাদি করেই বসবাস করছেন তারা।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলখানা মোড় পশ্চিমের নিচু জমি ও খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করছেন বেদেরা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এদের মধ্যে সাপ না থাকলেও দুই বেলা খাবারের জন্য তাদের কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি বানরের খেলাসহ বিভিন্ন রোগের তাবিজ-কবজ, সিঙা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, কটক মাছের কাঁটা ও বাত-ব্যথার তেল বিক্রির জন্য বেড়িয়ে পড়েছেন।
বেদেরা জানায়, আগের মতো এখন আর নদী নেই, নদীতে পানি নেই, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য এসে নদীর পানি নষ্ট ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব পানি দিয়েই তারা গোসলসহ সকল প্রকার কাজ করছেন। তাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা। আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবেই চলছে তাদের জীবন।
প্রতিটি বেদে বহর এক একটি রাজ্যের মতো কল্পনা করে এরা। সর্দার এদের রাজা। তার নিয়ন্ত্রণে চলতে হয় বহরের সবাইকে। বেদে বহরের মেয়েরাই আয়ের জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়ায়। পাড়া মহল্লা ঘুরে মানুষের নানা কথা শুনে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। অভাব অনটনের কারণে পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে, দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। শাড়ি, চুড়িসহ বিক্রি করছে নানা প্রসাধনী।
স্থানীয় সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মীদের মতে, সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবেই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়ের শিশুরা। তারা বেদে সম্প্রদায়কে পুনর্বাসন করে তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।
বেদে নুর নাহার বলেন, ‘সাপের খেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে কিছু টাকা রোজগার করে পেট চালাই। তিন বেলা ভালো করে খেতে পারি না আবার শিশুদের পড়ালেখা করাব কি করে? সরকারতো বেদে শিশুদের জন্য বিনা বেতনে পড়ার জন্য আলাদা কোনো স্কুল-কলেজ করে দেয়নি। সরকার আসে সরকার যায় আমাদের মতো বেদে সম্প্রদায়ের ভাগ্য বদলায় না।’
বেদে আয়শা বলেন, ‘কোনো বাসাবাড়িতে কামকাজ করতে আমাগো রাহে না মানুষ। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হইয়া আপনাগো মতন সাহেবগো কাছে আইসা হাত পাতি। হাতে-পায়ে ধইরা যা পাই তা দিয়া পোলাপাইনের জন্য সদাই নিয়া ডেরায় ফিরি। কোনো কোনো দিন ফিরতে অনেক দেরি হয়। সেদিন পোলাপানইরা সারাদিন না খাইয়া আমাগো পানে চাইয়া থাকে। শেয়াল-কুকুরের সঙ্গে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস আমাগো। রোগবালাই হইলেও কোনো হাসপাতালে ভর্তি নেয় না। আমরা সব থেকে কষ্টের ভেতর আছি। কারও কাছ থেকে আইজ পর্যন্ত আমরা কোনো খাবার পাই নাই। আমাদের কেউ খবরও নেয় না।’
বেদে পল্লীর সরদার কাদের বলেন, ‘আমাদের একদিকে বেঁচে থাকা, অন্যদিকে বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখার জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। স্ত্রী-সন্তান, ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে বসবাস করে জীবন বাঁচার জন্য লড়াই করেই যাচ্ছি। আমাদের বেদে সম্প্রদায়ের যতই দিন যাচ্ছে ততই করুণ পরিণতি বাড়ছে।’
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মজিব আলম জানান, জেলখানা মোড় এলাকায় যে একটি স্থায়ী বেদে পল্লী রয়েছে এবং সেখানকার শিশুরা যে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না সেটি আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে, বেদে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান খান বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন করে বেদে সম্প্রদায়কে সামাজিক মানোন্নয়নে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এ বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করে সরকারকে দেওয়া হবে। আমাদের যা করনীয় আছে তাদের করা হবে। একইসাথে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। তাদের ব্যাপারেও খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।