এম এ হান্নান, বাউফল (পটুয়াখালী)
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪১ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:১৬ পিএম
ভাষা সৈনিক সৈয়দ আশরাফ হোসেনের সমাধিস্থল। প্রবা ফটো
৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বের হওয়া মিছিলের দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন ভাষা সৈনিক সৈয়দ আশরাফ হোসেন। ওই মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ সেলিমের রক্তমাখা জামা পটুয়াখালীতে নিয়ে আসেন তিনি। পরে পটুয়াখালী জুবলি স্কুল মাঠে ভাষা আন্দোলনের প্রথম জনসভায় সেই রক্তমাখা জামা জনসম্মুখে তুলে ধরেন তিনি।
৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। বাংলা ভাষা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার পরেও এ মহান মানুষটির সমাধিস্থল চরম অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে। তার স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্র কিংবা স্থানীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি এ ভাষা সৈনিককে মাতৃভাষা দিবসেও স্মরণ করা হয়নি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিবার ও স্থানীয়রা। সৈয়দ আশরাফের স্মৃতি সরক্ষণে সমাধি কমপ্লেক্স নির্মাণ, স্মৃতিফলক ও স্মৃতি পাঠাগার নির্মাণের দাবিও করেছেন তারা।
জানা যায়, সৈয়দ আশরাফ হোসেন ১৯২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ধুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আছমত আলী ছিলেন একজন কৃষক। তিনি ধুলিয়া বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, বরিশাল বিএম কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. কম ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাবির ছাত্র থাকাকালীন ঢাকার রাজপথে ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ড. আখলাকুর রহমান, তোহা খান, অলি আহাদ, গাজীউল হক ও এবিএম আবদুল লতিফদের সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন। ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পদেও ছিলেন। ৬৫’র নির্বাচনে তিনি পটুয়াখালী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মহান এ মনীষী ২০০৮ সালের ৩ মে মারা যান। বাউফলের গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, ধুলিয়া গ্রামের তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে ভাষা সৈনিক আশরাফ হোসেনেরে উম্মুক্ত সমাধিস্থল। মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি। সমাধিস্থলে সীমানা দেয়াল না থাকায় অবাধে গরু-ছাগল বিচরণ করছে। নেই কোনো স্মৃতিফলক। ছোট একটি ব্যানারে রয়েছে নাম-পরিচয়। একজন ভাষা সৈনিকের সমাধিস্থল এমন অবহেলিত হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, সৈয়দ আশরাফ হোসেন পটুয়াখালী জেলার গর্ব। তিনি ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। তার প্রচেষ্টায় পটুয়াখালীতে ছাত্র-যুবক-জনতা রাজপথে নেমে আসেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকও ছিলেন। তার মত একজন মহান মানুষের সমাধি পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।
ধুলিয়া এন. কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুননেছা বলেন, ‘ভাষা সৈনিক সৈয়দ আশরাফ হোসেনের স্মৃতি ও তাকে স্মরণীয় করে রাখতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ কারণে শিক্ষার্থীরা জানে না, তিনি কে ছিলেন? সরকারের কাছে দাবি, ভাষা সৈনিক সৈয়দ আশরাফ হোসেনের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।’
ধুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফ হোসেনের স্মৃতি সংরক্ষণে বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। আমার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আগামীতে তার সমাধি সংরক্ষণে প্রকল্প নেওয়া হবে বলে।’
সৈয়দ আশরাফ হোসেনের ছেলে মাইনুল হাসান সুমন বলেন, ‘আমার বাবা দেশ এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কাজ করেছেন। এখন রাষ্ট্র কিভাবে তাকে মূল্যায়ণ কববে সেটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ২০২২ সালে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিকদের সম্মাননা জানানোর জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত ও অসমাপ্ত ওই আয়োজনই আমার দেখা রাষ্ট্রপক্ষের একমাত্র উদ্যোগ। যেখানে আমরা সম্মানিত হওয়ার বদলে আহত হয়েছি।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক সৈয়দ আশরাফের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও স্মৃতিফলক নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’