সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৫১ পিএম
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১৩ পিএম
সূর্যমুখী ফুল ক্ষেত যেন মাটির বুকে বিছানো বিশাল আকৃতির হলদে চাদর। প্রবা ফটো
দূর থেকে দেখলে মনে হবে মাটির বুকে বিছানো বিশাল আকৃতির হলদে চাদর। তবে কাছে গেলেই সেই ভুল ভাঙবে। আর চোখে পড়বে উঁচু করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি সূর্যমুখী ফুল। বাতাসে দুলতে থাকা ফুলগুলো যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সৌন্দর্য উপভোগ করতে। চোখ জুড়ানো এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে দিনভর এ সূর্যমুখী বাগানে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। শস্য ফুলের পাশাপাশি এ সূর্যমুখীকে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে কৃষকদের। দর্শনার্থীরা যেমন ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত, তেমনি ফলন ভালো হওয়ায় খুশি কৃষক। ফলন দেখে অন্য কৃষকরাও উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। কৃষি কর্মকর্তারাও সূর্যমুখী ফুলের চাষ নিয়ে আশাবাদী।
অবসর সময় ও দুপুরের তপ্ত রোদের পরে সূর্যমুখী বাগান পরিণত হয় নানা বয়সী মানুষের মিলনমেলায়। সূর্যমুখী ফুলের বাগানটি এখন সৌন্দর্যপ্রেমীদের কাছে দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। সূর্যমুখী চাষে দিন দিন আগ্রহও বাড়ছে কৃষকদের। তেলবীজ উৎপাদনের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে কৃষি পর্যটনের নতুন সম্ভাবনাও। জনপ্রিয় এ সূর্যমুখীর বাগানে কেউ বন্ধু-বান্ধব কিংবা কেউ আসছেন পরিবার নিয়ে। কেউ শাড়ি পড়ে, কেউবা আবার সালোয়ার-কামিজ পরে তুলছেন ছবি বা সেলফি। কেউবা আবার ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাগানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। বড়দের সঙ্গে শিশুরাও মেতেছে সমান আনন্দে।
মনোমুগ্ধকর এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়েনের বড় আজলদী এলাকার দুই একর মাঠ জুরে সূর্যমুখী ফুলের বাগানে। কম খরচে অধিক লাভ হওয়ায় এ বাগান করতে আগ্রহী হয়েছেন কৃষকরা। আবার এ বাগানের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন শত শত প্রকৃতিপ্রেমী হাজির হন। শুধু স্থানীয়রাই নন, আশপাশের জেলা থেকেও আসছেন অনেকে। পিছিয়ে নেই ভিডিও তৈরি করা ব্লগার, ইউটিউবার ও টিকটকাররাও।
প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায়, ফুলগুলোও সেদিকে যায়। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় ফুলগুলো তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে এগুলো রাতব্যাপী সময়ে আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এ চক্র চলতে থাকে। তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায়- সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এ দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে, সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এ চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এ চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।
সরেজমিনে পাকুন্দিয়া উপজেলা চন্ডিপাশার বড় আজলদী গ্রামে দেখা যায়, দুই একর মাঠ জুড়ে সূর্যমুখী ফুলের হাসি- চোখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন সূর্য ঝলমলিয়ে হাসছে। কাছে গেলে চোখে পড়ে হাজারো সূর্যমুখী ফুল। বাতাসে দোল খেয়ে ফুলগুলো যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সৌন্দর্য উপভোগ করার। সূর্য যখন যেদিকে হেলছে, সূর্যমুখী ফুলও সেদিকে হেলে পড়ছে। চারদিকে হলুদ রঙের ফুলের মনমাতানো ঘ্রাণ আর মৌমাছিরা ছুটছেন এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। তাতে মুখরিত হয়ে উঠেছে কৃষকের জমি। এটি যেন ফসলি জমি নয়, এ এক দৃষ্টিনন্দন বাগান। তবে সূর্যমুখী ফুল চাষের লক্ষ্য নিছক বিনোদন নয়। মূলত ভোজ্যতেল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা মেটাতে এ চাষ করা হচ্ছে। তাই অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে লাভের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
শিক্ষার্থী ইভা আক্তার বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারণ সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল, যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে। তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সূর্যমুখীর বাগান দেখতে আসা জেবিন আক্তার বলেন, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারণে আরও বেশি ভালো লাগে। এটাকে অনেকেই শখ করে বাড়ির টবে লাগান। তবে এত বড় বাগান আমাদের চোখে তেমন একটা পড়ে না। দেখে মনে হচ্ছে, সবুজের মাঝে একখণ্ড হলুদ গাছ বাতাসে দোল খেয়ে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। বিস্তীর্ণ সবুজের মাঠে হলুদ আর সবুজ মিশেলে অপরূপ সূর্যমুখীর এ দৃশ্য দেখে আমি অনেক মুগ্ধ। এমন এক মায়াবি দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করতে পেরে অনেক খুশি আমি।
পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা গৃহবধূ রিতু আক্তার বলেন, শহরে এমন সূর্যমুখী বাগানের ফুল দেখা যায় না। গ্রামের এ মাঠে সূর্যমুখী বাগানের ফুল দেখে খুব আনন্দিত আমরা।
স্থানীয় বাসিন্দা লাদেন মিয়া বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্যবর্ধনে যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে, তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর, সূর্যমুখীও এর ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায়, খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর, এটির তেলও খুব পুষ্টিকর।
ইউটিউবার খাইরুল ইসলাম জানান, ফেসবুকে দেখলাম এ বাগানে অনেকেই ছবি তুলেছে। অবশেষে আমিও সূর্যমুখী বাগানে ঘুরতে এসেছি। এসে খুব ভালো লাগছে। তাই একটি ব্লগ তৈরি করার পাশাপাশি বেশকিছু ছবি তুললাম এবং কয়েকটি ভিডিও তৈরি করলাম।
স্থানীয় কৃষক আকরাম হোসেন জানান, ধান ওঠার পর পড়ে থাকা জমিতে এ বছর সূর্যমুখীর বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সূর্যমুখী তেলের গুণাগুণ শুনে ও বাম্পার ফলন দেখে তিনিও আগামী বছর সূর্যমুখী চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সূর্যমুখী চাষি আব্দুল মোমেন জানায়, সরকারি প্রণোদনা ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে বীজ ও সার পেয়ে এ বছর প্রথম সুর্যমূখীর চাষ করেছেন তিনি। প্রথমে তেমন আগ্রহ না থাকলেও ফলন দেখে অনেক ভালো লাগছে। প্রতিটি গাছে অনেক বড় বড় ফুল হয়েছে। কম খরচে অধিক ফসল পাওয়া যায় ও সূর্যমুখী তেলের চাহিদা রয়েছে। এ কারণে আমরা এ ফসলটি আবাদ করেছি। এছাড়া সূর্যমুখী ফুলের বাগানের মনোরম দৃশ্য দেখতে ও ছবি তুলতে প্রতিদিন ভিড় করছেন অনেকেই। আবহাওয়া ও বাজার ভালো থাকলে অনেক টাকা লাভ হবে। তার মতো আরও কৃষক সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হয়েছেন। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে চাষ করবেন বলে তিনি জানান।
উপজেলা চন্ডিপাশা ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, এ এলাকার মাঠ সূর্যমুখী চাষের জন্য খবুই উপযোগী। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে ও কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ না আসে, তাহলে আশা করছি একরে প্রায় ৮০০-১০০০ কেজি সূর্যমুখীর বীজ সংগ্রহ করা যাবে। এ বীজ থেকে ৩৫-৪০ ভাগ তেল উৎপাদন করা যাবে। তেলের পাশাপাশি উৎপাদিত খৈল পাখি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে বিক্রি করে বাড়তি আয় সম্ভব।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম জানান, তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় সরকারের প্রণোদনা ও পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় এবং কৃষি বিভাগের দেখাশোনায় পতিত জমিতে সূর্যমুখী ফসল আবাদ করে কৃষকরা বাম্পার ফলন পেয়েছে। সূর্যমুখীর বীজ থেকে উৎপাদিত তেলে লিনোলিক অ্যাসিড থাকে, যা হার্টের জন্য ভালো। এছাড়া এ তেল আমাদের শরীরের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। সূর্যমুখী তেলের উৎপাদন বাড়লে মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত তেল পাবে, চাষিরাও লাভবান হবেন। কম খরচে বেশি লাভের সুযোগ থাকায় এ উপজেলার অনেকেই সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।