ইস্টার্ন রিফাইনারি
হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:১৩ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর গত ১৫ বছরে একাধিকবার সংশোধন করা হয় প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে এস আলম গ্রুপকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার পর ফের ডিপিপি সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তাতেও গতি আসেনি জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পে। একাধিকবার ডিপিপি সংশোধন করার পরও অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্যও নেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কিংবা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) কর্মকর্তাদের কাছে। তারা বলছেন, অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়া না গেলে থমকে যাবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী আমীর মাসুদ বলেন, আগস্ট মাসে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানোর পর বিষয়টি একইভাবে আছে। এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সংশোধিত যে ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়, সেটার ভিত্তিতে ৭০ শতাংশ জিওবি এবং ৩০ শতাংশ বিপিসি অর্থায়ন করার যে সিদ্ধান্ত হয়, সেই অনুযায়ী এখন অর্থায়নকারী খোঁজা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে ইআরডিতে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। ইআরডি থেকে এখনও কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি। যদি অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঠিক হয়, তাহলেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। অন্যথায় প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
এদিকে গত ১৫ বছরেও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন না হওয়ায় জ্বালানি তেল পরিশোধনের জন্য এখনও নির্ভর করতে হচ্ছে স্বাধীনতার আগে নির্মিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের পুরোনো প্রকল্পের ওপর। আর তাতে দিন দিন দেশে বাড়ছে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি-নির্ভরতা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পরিশোধন করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর বিদেশে পরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানি করত সেখানে এখন চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে ফিনিশ প্রোডাক্ট (পরিশোধিত) হিসেবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা ছিল প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত মোট জ্বালানি তেলের পরিমাণ ৬৭ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ১৫ লাখ মেট্রিক টনের। পরিশোধনের সক্ষমতা না থাকায় বাকি জ্বালানি তেল আমদানি হয় ফিনিশ প্রোডাক্ট (পরিশোধিত) হিসেবে। তাতে অতিরিক্ত খরচ হিসেবে জ্বালানি তেল আমদানিতে কোটি কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। চাহিদার সবটুকু জ্বালানি তেল অপরিশোধিত এনে যদি দেশে পরিশোধন করা যেত তাহলে বিপুল পরিমাণ এই ডলার দেশে থেকে যেত।
ফলে দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ক্রুড অয়েল পরিশোধনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জ্বালানি খাতে শুধু ডলার সাশ্রয় হবে তা নয়, দেশে তেলের দামও কম থাকবে। পাশাপাশি ডিজেল-পেট্রোলের বাইরে অকটেন, ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, কেরোসিনসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল আছে সেগুলো আমদানি করতে হবে না। উল্টো নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এসব জ্বালানি তেল বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশের মোট জ্বালানি তেলের চাহিদার ৬২ দশমিক ৯৩ শতাংশ ডিজেল, ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ পেট্রোল, ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ অকটেন, ১ দশমিক ০৩ শতাংশ কেরোসিন, ৮ শতাংশ জেট-এ-১ এবং ১ দশমিক ৮০ শতাংশ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য। ক্রুড অয়েল এনে পরিশোধন করলে ডিজেল ছাড়া অন্য জ্বালানি তেলগুলোর দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারত বাংলাদেশ।
দেশের অর্থনীতির জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ প্রকল্পটি। ২০১০ সালে সরকার প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত ৮ থেকে ১০ বার প্রকল্পটির ডিপিপি পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা হয়। এরপরও অর্থায়ন জটিলতায় আলোর মুখ দেখছে না প্রকল্পটি। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি মাসে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। সেই অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এস আলম গ্রুপ যুক্ত হয় এই প্রকল্পে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, অপরিশোধিত তেল পরিশোধনে ২০১০ সালে দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২) নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। অর্থায়নসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। দীর্ঘদিন এভাবে ঝুলে থাকার পর ডলার সংকটে জ্বালানি তেলের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। এরপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পুনরায় তোড়জোড় শুরু করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারি অর্থায়ন চেয়ে ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠায় বিপিসির পরিকল্পনা বিভাগ। প্রস্তাবনায় বিপিসির পক্ষ থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৭০ শতাংশ সরকারি অর্থায়নের আবেদন করা হয়। প্রস্তাবনার আলোকে ওই সময় ৫ শতাংশ সুদে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ উন্নয়ন ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয় অর্থ বিভাগ। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানোর পর আবারও থমকে যায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। এভাবে এক বছর পার হওয়ার পর প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের ২৯ জানুয়ারি এস আলম গ্রুপ ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবের আলোকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং এস আলম গ্রুপ যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে বিপিসিকে অবহিত করা হয়। এর চার মাসের মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২৯ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্প থেকে এস আলম গ্রুপকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানোর পর এখন আবারও থমকে আছে প্রকল্পটি।
ওই সময় মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের মধ্যে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন প্রস্তাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পটির বৈদেশিক মুদ্রার হালনাগাদ দর অনুযায়ী প্রাক্কলন এবং সব ক্রয় পরিকল্পনা পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাঠাতে বিপিসিকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর প্রকল্পটির আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।