× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভাষা আন্দোলনে পটুয়াখালী

এনায়েতুর রহমান, পটুয়াখালী

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০৬ পিএম

আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১১ পিএম

ভাষা আন্দোলনে পটুয়াখালী

বাংলা ভাষার দাবিতে সারা পূর্ববাংলা জেগে উঠেছিল। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই- এই স্লোগানে সেই সময়ে পটুয়াখালী শহরও প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনে পটুয়াখালীরও রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এ কথা জানেন। সেদিনের ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ভাষা সৈনিকদের প্রায় সবাই আজ প্রয়াত। তবে এখনও বেঁচে আছেন দু-একজন ভাষাসৈনিক। 

১৯৫১ সালে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার রামপুর গ্রামের আলী আশরাফ ও তৎকালীন গলাচিপা থানার (বর্তমানে রাঙাবালী) বড়বাইশদা ইউনিয়নের আবদুল করিম মিয়া ভাষা আন্দোলনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ওই বছর ২৩ ডিসেম্বর পটুয়াখালী শহরের সদর রোড নুতন বাজার এলাকায় আজাদ ফার্মেসির পূর্বপাশে কাদের হাওলাদারের বাসায় গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে আবদুল করিম মিয়াকে সভাপতি ও কবি খন্দকার খালেককে সম্পাদক করে গঠন করা হয় ‘পটুয়াখালী মহকুমা ভাষা আন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি’। পরে এ কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। 

পটুয়াখালীর আলী আশরাফ ছিলেন রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অবিসংবাদিত নেতা। বরিশাল জেলা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার ইছাদি গ্রামের আবুল হাশেম। উভয়ের বাড়ি পটুয়াখালীতে হওয়ায় তারা সিদ্ধান্ত নেন বরিশালের সমতালে পটুয়াখালীতেও ভাষা আন্দোলন বেগবান করার।

রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে পটুয়াখালী আসেন বরিশাল জেলা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবুল হাশেম । ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কাদের হাওলাদারের বাসায় ফের গোপন বৈঠকে বসে কবি খন্দকার খালেককে আহ্বায়ক ও জালাল উদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় ‘পটুয়াখালী মহকুমা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ওই কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন গাজী আজাহার উদ্দিন, আবুল হোসেন আবু মিয়া, আইনজীবী গোলাম আহাদ চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন শিকদার, এ টি এম ওবায়দুল্লাহ, রাখাল ব্যানার্জী, আবদুল খালেক, বীরেশ্বর বসু, শিক্ষক অতুল চন্দ্র দাস, ধ্রুব জ্যোতি দত্ত, মজিবুর রহমান নয়া মিয়া, শাহাদত উল্লাহ, কাজল আহমেদ, দেবী দাস, আইনজীবী আবদুল মতলেব, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, দলিল উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। 

ভাষা সৈনিক মো. দলিল উদ্দিন আহমেদ

ওই কমিটির মধ্যে না থেকেও সংকটের সময়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে কর্মীদের সংগঠিত ও সাহস জুগিয়েছেন পটুয়াখালী এমএলএ এমদাদ আলী অ্যাডভোকেট। তার নেতৃত্বে একাত্মতা প্রকাশ করে সহযোগিতার হাত বাড়ান বি ডি হাবিবুল্লাহ, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, আইনজীবী কে বি এম শামসুল হক, আবদুর রাজ্জাক ভেন্ডার, মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া, মাখন লাল দেউরি, শামসুল আলম, রাধেশ্যাম দেবনাথ, শংকর লাল দাস, অধ্যাপক গাজী নেছার উদ্দিন, এ কে এম হোসেন মিয়া অ্যাডভোকেট, মেশারফ হোসেন বিশ্বাস, আবদুল মন্নান মিয়া, এমদাদ আলী অ্যাডভোকেটের তিন কন্যা শিক্ষিকা এ এন অনোয়ারা বেগম, ডাক্তার কামরুন নেসা ও অ্যাডভোকেট জেবুন নেসাসহ অন্যরা। গ্রেপ্তার হুলিয়া ও গুলির মুখে আপদকালীন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছিলেন তারা। ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেওয়ায় ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৮ দিন কারাবরণ করেন এম এল এ এমদাদ আলী অ্যাডভোকেটের কন্যা তখনকার কলেজ ছাত্রী ডাক্তার কামরুন নেসা। 

ভাষা আন্দোলনে ঢাকার সঙ্গে পটুয়াখালীর যোগসূত্র রাখার দায়িত্ব পালন করেন বাউফলের এ বি এম আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আশরাফ হোসেন। পটুয়াখালীতে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত সংগ্রামে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এসব নেতা আজ অনেকেই বেঁচে নেই। তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা দলিল উদ্দিন আহমেদ। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।

কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও শহরে সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশের এক গোপন সূত্রে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলি করে শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার খবর এলে দেখা দেয় উত্তেজনা। মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি জরুরি বৈঠকে বসেন আজাদ ফার্মেসির দোতলায়। সিদ্ধান্ত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও জুবিলী স্কুল ময়দানে গণসমাবেশ কর্মসূচি পালনের। 

কিন্তু বৈঠকের সিদ্ধান্তের খবর পেয়ে যায় স্থানীয় প্রশাসন। হুলিয়া জারি হয় সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের বিরুদ্ধে। তারা গা-ঢাকা দিয়ে চলে যান নিরাপদে। কর্মসূচি সফল করা নিয়ে দেখা দেয় ভয়, সংকট ও অনিশ্চয়তা। এ সময় এগিয়ে আসেন এমএলএ এমদাদ আলী অ্যাডভোকেট। রাতে শহরের আদালতপাড়ায় বড় মসজিদ মহল্লা সড়কে তার বাসভবনে গোপন বৈঠকে বসেন জয়নাল আবেদীন শিকদার, কবি খন্দকার খালেক, কে বি এম শামসুল হক, জালাল আহমেদ, আবদুল করিমসহ অন্যরা। তারা সিদ্ধান্ত নেন কর্মসূচি সফলের আহ্বান জানিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শহরে লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশ করার। কবি খন্দকার খালেকের লেখা ‘রক্ত শপথ’ নামের লিফলেট ছাপাতে ওই রাতে একমাত্র রাজি হন আর্ট প্রেসের মালিক মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষেই শহরে বিলি করা হয় লিফলেট। উত্তেজিত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। চরপাড়া পুরাতন রেজিস্ট্রি পুল সড়কে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে কর্মসূচি সফল করতে শহরের আদালত পাড়ায় বড় মসজিদ মহল্লা রোডে এমদাদ আলী অ্যাডভোকেটের বৈঠকখানার উত্তর পাশে বড়মসজিদ সংলগ্ন মাঠে সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। পটুয়াখালীতে প্রথম প্রকাশ্য ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন এমদাদ আলী অ্যাডভোকেট। ওই সভায় ২৩ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন বি ডি হাবিবুল্লাহ, এ বি এম আবদুল লতিফ, আবদুল করিম মিয়া, আলী আশরাফ, এমদাদ আলী অ্যাডভোকেটের দুই কন্যা আনোয়ারা বেগম ও জেবুন নেছা। সমাবেশে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার উপস্থিতি দেখে টনক নড়ে প্রশাসনের। কর্মসূচি বানচালে আরও তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। শুরু হয় নেতাদেরকে গ্রেপ্তারে পাড়ায় মহল্লায় পুলিশি অভিযান। তল্লাশি চালানো হয় সকল ছাপাখানায়। সন্দেহ হয় শহরের আর্ট প্রেসের ওপর। পরবর্তী সময়ে সরকারি কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ বছর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে ওই প্রেসে।

বায়ান্নর ২৩ ফেব্রুয়ারি উত্তাল হয়ে ওঠে পটুয়াখালী শহর। ছাত্র-জনতার ঢল নামে রাস্তায়। শহরের মোড়ে মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয় দাঙ্গা পুলিশ। সবকিছু উপেক্ষা করে সকাল ৯টার মধ্যে জুবিলী স্কুল ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ। স্মরণকালের বৃহৎ গণসমাবেশে মিলিত হয় ছাত্র-জনতা। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পলাতক থাকায় সংকট দেখা দেয় হুলিয়া মাথায় নিয়ে কে করবেন এই গণসমাবেশের সভাপতিত্ব। তখন সংকট উত্তরণে সাহসী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন পটুয়াখালীর এমদাদ আলী। উপস্থিত ছাত্র-জনতার স্লোগান ও করতালি দিয়ে স্বাগত জানান তাকে। সমাবেশে বক্তৃতা করেন সৈয়দ আশরাফ হোসেন, আইনজীবী গোলাম আহাদ চৌধুরীসহ অন্যরা। 

এ সময় সৈয়দ আশরাফ হোসেন জনতার উদ্দেশে তুলে ধরেন ঢাকা থেকে নিয়ে আসা শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। গণসমাবেশ শেষ করে পুরো শহরে রাস্তায় বের হয় বৃহৎ বিক্ষোভ মিছিল। টিনের চোঙ্গা দিয়ে স্লোগান দেয় আবদুল মন্নান মিয়া। পালিত হয় হরতাল। এ সময় পুলিশ বাধ্য হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। 

এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে স্টিমারে পটুয়াখালী আসেন গলাচিপার এমএনএ সামছুদ্দিন সানু মিয়া ও বেতাগীর এমএনএ আবদুর রহমান খান নুরু মিয়া। শহরের স্টিমার ঘাটে জনতা তাদেরকে ঘেরাও করে। বাধ্য করা হয় পদত্যাগপত্র লিখে দিতে। ফলাও করে তা ছাপা হয় পত্রিকায়। পরে তারা তা অস্বীকার করে বলেন, জোর করে তাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র লিখে নেওয়া হয়েছে।

মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই পটুয়াখালীতে একটি পাঠাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভে এমএলএ নির্বাচিত হন ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মোহাম্মদ এমদাদ আলী ও আবদুল করিম মিয়া। সুযোগ আসে পাঠাগার স্থাপনের।

পটুয়াখালীতে বেঁচে থাকা ভাষাসৈনিক দলিল উদ্দিন আহমেদ শহরের কাঠপট্টি এলাকায় তার বাসভবনে প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। পটুয়াখালীতে ভাষা আন্দোলনে যারা অবদান রেখেছেন তাদের গৌরবগাথা স্মরণ করতে হবে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পটুয়াখালীতে ১৯৬৪ সালে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয় পটুয়াখালী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে শ্রদ্ধা জানাত সবাই। পরে নব্বইর দশকে পটুয়াখালী পৌরসভা কর্তৃক পৌরসভা কার্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মাণ করে শহীদ মিনার। সেটি স্থানান্তর করে ২০২৪ সালে জেলা শহরের ডিসি বাংলোর দক্ষিণ পাশে সুবিশাল আঙ্গিনায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এখানেই শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা