রফিকুল ইসলাম সান, বেড়া, সাঁথিয়া (পাবনা)
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:৩৭ এএম
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:১৩ পিএম
পদ্মা-যমুনার নৌ-চ্যানেলে সারা বছর ড্রেজিং কার্যক্রম চালানো হলেও নদীর নাব্যতা সংকট দূর হচ্ছে না। এ জন্য অপরিকল্পিত ড্রেজিং ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে ভুক্তভোগীরা। গত মঙ্গলবার নগরবাড়ী ঘাট এলাকায়। প্রবা ফটো
আরিচা-কাজিরহাট-নগরবাড়ী-বাঘাবাড়ী উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট। রুটটি সচল রাখতে নাব্যতা সংকট নিরসনের জন্য বারবার করা হচ্ছে ড্রেজিং। তারপরও কোনো কাজেই আসছে না।
স্থানীয়দের মতে, ড্রেজিংয়ে একদিকে যেমন সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে, অন্যদিকে কার্গো জাহাজ ও ফেরি চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, এ বছর শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নদীতে পানি কমে ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় নৌ-চ্যানেল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে ফেরি কর্তৃপক্ষ গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনবার ফেরি চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখে। দ্রুতগতিতে পানি কমার কারণে নাব্যতা সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। পানি কমে ও বালুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় চ্যানেলের অবস্থা দিন দিন একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা। নৌ-চ্যানেলের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে যে কোনো সময় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে কার্গো জাহাজ ও ফেরি চলাচল। ফারাক্কা ও গজলডোবা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে পদ্মা ও যমুনায় দ্রুতগতিতে পানি হ্রাস ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং ব্যবস্থার কারণেই আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটের এ দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে নৌযান চালকরা মনে করছেন।
সূত্র জানায়, আরিচা-কাজিরহাট-বাঘাবাড়ী নৌবন্দর নৌরুট সচল রাখতে গত বছরের ২৮ জুলাই থেকেই পদ্মা ও যমুনা নদীতে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং ইউনিটের নিজস্ব ১০টি ড্রেজার দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পলি অপসারণের কাজ করছে। নৌরুটটি সচল রাখতে এ পর্যন্ত ২৯ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফল।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগের একটি সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহ একসঙ্গে ধারণ করে যমুনা নদী প্রবহমান। উজানে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে পদ্মা নদীতে পানিপ্রবাহ মারাত্মক কমে গেছে। এর ফলে পদ্মা ও যমুনায় নাব্যতা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
স্থানীয় নগরবাড়ী ঘাটের শ্রমিক সরদার ঝন্টু মিয়া বলেন, বিআইডব্লিউটিএর যে ড্রেজার রয়েছে, তা ঠিকমতো কাজ করছে না। যা করছে তাও আবার অপরিকল্পিত। ড্রেজিংয়ে যে পলিমাটি পাইপের সাহায্যে উজানে চরে ফেলা হচ্ছে, তা আবার বর্ষার সময় ভাটিতে এসে জমা হচ্ছে। এভাবে অপরিকল্পিত ড্রেজিয়ের কারণেই নাব্যতা সংকট নিরসন হচ্ছে না।
জাইদুল ইসলাম নামের অপর শ্রমিক বলেন, বিআইডব্লিউটিএ প্রায় বছরজুড়েই ড্রেজিং করছে যমুনা নদীতে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ড্রেজিং করলে আর সারা বছর এই কাজ করতে হতো না। সরকারের আর কোটি কোটি টাকাও গচ্চা যেত না।
আরেক শ্রমিক সরদার হাবিবুর রহমান হাবি বলেন, যদি এমপি বাজার থেকে রঘুনাথপুর পর্যন্ত একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, তাহলে এই নৌরুট সচল রাখতে বছরজুড়ে ড্রেজিং করতে হবে না। কিন্তু কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এভাবে সারা বছর শুধু ড্রেজিং করছে, তাতে সরকারের শুধু কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। একদিকে উজানে বালি ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে সেই বালির সঙ্গে পলি এসে চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং নাব্যতা সৃষ্টি করছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা ঘাটের ব্যবস্থাপক আবু আব্দুল্লাহ বলেন, আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ঝুঁকি নিয়ে ফেরি চলাচল করছে। এভাবে কতদিন চলবে তা বলা মুশকিল। কারণ নাব্যতা সংকটের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। পানি কমে যাওয়ায় চ্যানেলে পলি পড়া অব্যাহত রয়েছে। কয়েক মাস ধরে ড্রেজিং অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এতে তেমন কোনো সুফল মিলছে না। এ অবস্থায় যেকোনো সময় আবার ফেরি ও কার্গো চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে, বিআইডব্লিউটিসির কাজিরহাট ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুজ্জামান বলেন, নাব্যতা সংকট আপাতত নেই। ফেরি নিয়মিতই চলছে। তবে ঘন কুয়াশার কারণে মাঝেমধ্যে ফেরি চলাচল সাময়িক সময় বন্ধ থাকলেও কুয়াশা কেটে গেলে আবারও চালু করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, আমাদের ড্রেজিংয়ের কাজ অব্যাহত রয়েছে। পুরোনো চ্যানেলের পাশে আরেকটি নতুন চ্যানেল খননের কাজ প্রায় শেষের পথে। গত বছরের খনন কাজ শুরু থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্ত আরিচা-কাজিরহাজ-বাঘাবাড়ী পর্যন্ত পদ্মা যমুনায় প্রায় ২৯ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পলি খনন করা হয়।
উজানে পলিমাটি বা বালি ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান মাহমুদ বলেন, অনেকে না বুঝে বলতেই পারে, এই চ্যানেলটি হলো দ্বিতীয় শ্রেণির নৌরুট। এই চ্যানেলে আট ফুট গভীরতা থাকলেই জাহাজ চলাচল করতে পারে। সেখানে বাস্তবে রয়েছে ১২ ফুট গভীরতা। নগরবাড়ীর মাটি এক হাজার ২০০ ফুট ভাসমান পাইপের মাধ্যমে এক হাজার ৭০০ ফূট দূরে চরে ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে এই চ্যানেলে মাটি আসা সম্ভব নয়। আমরা মাটি ফেলে দেখি পানি চলে এলে আস্তে আস্তে পাইপের মাধ্যমে লাইন বাড়িয়ে দিই। তিনি বলেন, নগরবাড়ী ঘাটে এখন একটি ড্রেজার রয়েছে, সেখানে কাটিং আপাতত শেষ। এই এলাকার জনসাধারণের একটি অনুরোধের ভিত্তিতে পোর্ট থেকে এমপি বাজার পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়েছে। আমরা জনসাধারণের জন্য কাজ করে থাকি। সে হিসেবে ওই জায়গা কেটে দিচ্ছি। তা ছাড়া বন্দর কর্মকর্তাদের ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনুরোধ ছিল এই মাটি কেটে দিলে ব্যবসায়ীদের খরচ কিছুটা কমবে।