হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১০ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বেড়েছে মাদার ভেসেলের (বড় জাহাজ) সংখ্যা। আমদানি বাড়ার পাশাপাশি লাইটার জাহাজ সংকটের কারণে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে আংশিক অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের গড় অবস্থান বেড়েছে। আগে যেখানে একটি কার্গো জাহাজ তিন-চার দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করে চলে যেত, সেখানে লাইটার জাহাজ সংকটে এক সপ্তাহ সময় লাগছে। স্বাভাবিক সময়ে একেকটি মাদার ভেসেলের জন্য ২ থেকে ৩টি লাইটার জাহাজ বরাদ্দ থাকলেও বর্তমানে একটির বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, লাইটার জাহাজে পণ্য মজুদ করার পাশাপাশি আমদানি বৃদ্ধির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এভাবে চললে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হবে। বন্দরে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলে জাহাজের ভাড়াও বাড়িয়ে দেবেন মেইনলাইন অপারেটররা। যার ফলে বাড়বে পণ্যের দাম। এ সংকটের দ্রুত সমাধানের দাবি তাদের।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে দেরি হওয়ার শিপিং লাইনগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাহাজগুলো বসে থাকার কারণে ডেমারেজ বাড়ছে। ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে আমদানিকারকদের খরচ বাড়ছে। এভাবে চললে মেইনলাইন অপারেটররা বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করবে। ভাড়া ও ডেমারেজ বাড়িয়ে দেবে তারা। সর্বোপরি এটি বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করবে। একসময় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে বেশি সময় লাগত, যেটি বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করত। এটি আমরা কাটিয়ে উঠছি। এখন আবার আগের মতো যদি বেশি সময় লাগে, তাহলে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে বড় জাহাজগুলো প্রথমে আসে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। এর মধ্যে সেসব জাহাজের গভীরতা কম সেগুলো বন্দরের জেটিতে এনে পণ্য খালাস করা হয়। আর যেসব জাহাজের গভীরতা বেশি সেগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে না পারার কারণে বহির্নোঙরে অবস্থান করে। পরে সেখান থেকে লাইটার জাহাজে করে পণ্য খালাস করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, মাদার ভেসেল থেকে খালাস করার পর পণ্যগুলো লাইটার জাহাজ মজুদ করে রাখছেন কিছু অসাধু আমদানিকারক ব্যবসায়ী। যে কারণে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজ সংকট তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে বাড়ছে আমদানি। এতে বন্দরের বহির্নোঙরে দিন দিন মাদার ভেসেলের সংখ্যা বাড়ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে বন্দরে কার্গো পণ্য খালাস হয়েছে ৮৪ লাখ ৭৬ টন। এর মধ্যে গম, চাল, ডালসহ অধিকাংশ খাদ্যপণ্য রয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৈরি করা জাহাজের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক-দেড় মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দরের আলফা, ব্র্যাভা এবং চার্লি এই তিনটি বহির্নোঙরে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি বড় জাহাজ পণ্য লাইটারিংয়ের জন্য থাকত। সেখানে এখন লাইটারিংয়ের জন্য অপেক্ষমাণ বড় জাহাজের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ৩১ জানুয়ারি যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের আলফা, ব্র্যাভা এবং চার্লি এই তিনটি বহির্নোঙরে ৪৬টি বড় জাহাজ ছিল। সেখানে ১০ দিনের ব্যবধানে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ ছিল ৬৪টি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাতারবাড়ি ও কুতুবদিয়া বহির্নোঙরেও একই অবস্থা। এক দেড় মাস আগে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি বহির্নোঙরে প্রতিদিন ৫০টির মতো বড় জাহাজ পণ্য লাইটারিংয়ের জন্য থাকত। সেখানে এখন লাইটারিংয়ের জন্য অপেক্ষমাণ বড় জাহাজের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। ৩১ জানুয়ারি যেখানে ৪৯টি বড় জাহাজ ছিল, সেখানে ১০ দিনের ব্যবধানে গত বুধবার মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া বহির্নোঙরে বড় জাহাজ ছিল ৫৬টি।
বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত আছি। সম্প্রতি দেশে পণ্য আমদানি বেড়েছে। এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পণ্য আমদানি হচ্ছে। কিন্তু যারা আমদানি করছেন, তাদের কিছু কিছু ব্যবসায়ীর নিজস্ব ওয়্যারহাউস নেই। যে কারণে তারা লাইটার জাহাজে পণ্য নেওয়ার পর সেগুলোকে ভাসমান ওয়্যারহাউস হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে এখন লাইটার জাহাজ সংকট দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত লাইটার জাহাজ না থাকায় মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসের জন্য চাহিদা অনুযায়ী লাইটার জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিদ্যমান সংকটের কারণ ও এর সমাধানে পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। লাইটার জাহাজ অ্যাভেইলেবেল করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে এই মজুদদারির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে। কিন্তু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হবে কার বিরুদ্ধে, আমদানিকারকরা তো বসে আছে ঢাকায়, তারা তো জাহাজে নেই। জাহাজ তো দোষী না, দোষী হচ্ছে আমদানিকারকরা। অনেক আমদানির পরও বাজারে সংকট থেকে যাচ্ছে। কারণ এসব আমদানিকারক। তাই তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা লাইটার জাহাজকে ওয়্যারহাউস হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের নামের তালিকা করছি। এসব আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।