সিএনজিচালিত অটোরিকশা
মোহন আখন্দ, বগুড়া
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫০ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫১ এএম
বগুড়া শহর এবং উপজেলা পর্যায়ে চলাচলরত সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোর মধ্যে গড়ে ৮৬ শতাংশেরই ফিটনেস নেই। ফিটনেসবিহীন অটোরিকশায় যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে গত দুই বছরে (২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) বগুড়ায় অর্ধশতাধিক অটোরিকশার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অটোরিকশায় থাকা নারী-শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে শতাধিক। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফিটনেস সনদ নবায়নের সুযোগ থাকলেও মালিকদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানায় বিআরটিএ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রতিবছর সিএনজিচালিত অটোরিকশার ফিটনেস পরীক্ষা করে থাকে। প্রতিবছর নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে ফিটনেস সনদ নবায়নের ক্ষেত্রে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ মূলত অটোরিকশার কাঠামো এবং তাতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের রি-টেস্ট সনদ অর্থাৎ সেটি নতুন করে গ্যাসের চাপ নিতে সক্ষম কি নাÑ সে সম্পর্কিত পরীক্ষার ফলাফল দেখে থাকে। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেগুলোর ইতিবাচক ফলাফল পেলেই কেবল ফিটনেস সনদ নবায়ন করা হয়।
বগুড়ায় বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সাল পর্যন্ত জেলায় ৭ হাজার ৬৫৮টি অটোরিকশাকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে প্রায় চারগুণ; ৩০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। প্রতিবছর নতুন করে গড়ে দুই হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে নামছে। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী রেজিস্ট্রেশন নেওয়া অটোরিকশাগুলোর মধ্যে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৬ শতাংশ অর্থাৎ ৬ হাজার ৪৩৩টিই ফিটনেস সনদ নবায়ন করেনি। আর রেজিস্ট্রেশনবিহীন ২২ হাজার অটোরিকশা অবৈধভাবে চলাচল করছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, অন্যান্য যানবাহনের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশার প্রতিবছর ফিটনেস সনদ নবায়ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেটি না করলে দণ্ড হিসেবে প্রতি মাসেই জরিমানার অর্থ গুনতে হয়। তবে সিএনজি অটোরিকশা মালিকদের আর্থিক সক্ষমতা এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ফিটনেস সনদ না নেওয়া অন্যান্য যানবাহনের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোকেও জরিমানা ছাড়াই ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফিটনেস সনদ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও অটোরিকশা মালিকদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে ফিটনেসবিহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।
বগুড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের অধিকাংশের মেয়াদ নেই। পাঁচ বছর পর পর পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি মানছেন না চালকসহ মালিকরা। বছরে একবার মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে চান না তারা। গ্যাস সিলিন্ডারগুলোয় প্রবল দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে গত দুই বছরে (২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) বগুড়ায় অর্ধশতাধিক অটোরিকশার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অটোরিকশায় থাকা নারী-শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে শতাধিক।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেসব সিলিন্ডার সংযোজন করা হয় সেগুলোর মেয়াদ বিশ বছর। কিন্তু গ্যাসের চাপ কমবেশি হওয়ার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়। তাই পাঁচ বছর পর পর রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) বা তার অনুমোদিত সিএনজি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ফিটনেস সনদ মিলবে। এজন্য প্রতি বছর ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় সিলিন্ডার রি-টেস্ট রিপোর্ট দেখানোর নিয়মও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় এক দশক আগে ৫টি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠান চালু হয়। কিন্তু গ্রাহক না পাওয়ায় ৪টি প্রতিষ্ঠানই ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। বর্তমানে টিএমএসএস সিএনজি কনভার্সন মোটর ও অটো ওয়ার্কশপ নামে মাত্র একটি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। কিন্তু সেখানেও কোনো গ্রাহক নেই বললেই চলে। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রিটেস্ট ফি আড়াই হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু অটোরিকশার মালিকরা পাঁচ বছর পর সেই সামান্য অর্থও খরচ করতে রাজি নন। ২০১৮ সালে মাত্র ৫০টি গ্যাস সিলিন্ডার টেস্ট করা হয়েছে। তারপরের বছরগুলোতে হাতে-গোনা ২/১টি করে অটোরিকশা মালিক এসেছেন।
ওই প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার অনেকটা তাজা বোমার মতো হয়ে গেছে। যেকোনো সময় বিস্ফোারিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই স্থানীয় প্রশাসনের এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সিলিন্ডার রি-টেস্ট করাতে অনাগ্রহের কারণ অনুসন্ধানে অটোরিকশার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। আর যারা জানেন তারা বাড়তি পয়সা খরচ করতে চান না। নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। আমিনুর রহমান নামে এক সিএনজি অটোরিকশা মালিক জানান, গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার বিষয়টি তার জানা নেই। বিষয়টি তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছেন। আবুল হোসেন নামে অপর একজনের ভাষ্য- এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ঝামেলা হয়নি। তাই সিলিন্ডার পরীক্ষা করার দরকার পড়েনি। তবে চালকরা আবার মালিক পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেছেন, মালিক পক্ষ না চাইলে তাদের করার কিছু নেই। সবকিছু জেনেও ঝুঁকি নিয়েই তাদের চলতে হয়।
বগুড়ায় বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) হারুন উর রশিদ জানান, অন্যান্য যানবাহনের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোকেও কোনো জরিমানা ছাড়া ফিটনেস নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, তারা ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেটি করে ফেলবেন। তবে যারা এতে সাড়া দেবেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা কঠোর হব।