আরমান হেকিম, ঢাকা ও সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০০ এএম
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫২ এএম
চট্টগ্রাম লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সিডিএ নির্মিত এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে। প্রবা ফটো
উন্নয়ন দৃশ্যমান করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয় শত শত প্রকল্প। যার অনেকগুলো এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ‘চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার হতে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ’ প্রকল্প। চট্টগ্রামবাসীকে উন্নয়নের চমক দেখাতে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও এটি এখন তাদের জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ণাঙ্গ নকশা না করেই প্রকল্প নেওয়ার কারণে তিন দফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বেশি। সেই সঙ্গে তিন বছরের প্রকল্পটি গিয়ে ঠেকছে আট বছরে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সভায় নতুন করে ছয় খাতের ব্যয় ও ছয় মাস মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়।
এসব বিষয়ে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্পটির গোড়ায় গলদ থাকায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যা হয়েছিল। কেননা সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ছাড়াই নকশা তৈরি করে প্রকল্প নেওয়া হয়। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছিল। আর ডিজাইন পরিবর্তন হলেই রেট শিডিউল পরিবর্তন হয়ে সব ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে মেয়াদও। এই যে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ যাচ্ছেÑ এই দায়ভার কেউ নেবে না। এখানে কিন্তু জনগণের করের টাকার অপচয় করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে।’
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা ডিপিপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। কিন্তু ভুল নকশা ও পরিকল্পনার কারণে প্রথম সংশোধনীতে প্রায় ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হয়। তারপরও প্রকল্পটির নানা কাজে অসঙ্গতি থেকে যায়। এজন্য সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় আরও ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি ৪০ লাখ। এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে মূল অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় বেশি খরচ হবে ১ হাজার ৬৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। কিন্তু চার দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছিল আগামী জুন পর্যন্ত। এতেও শেষ হবে না কাজ। ফলে এবার ছয় মাস বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হচ্ছে। এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে লাগবে ৮ বছর।
কাজের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা। শতাংশের হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯১ শতাংশ।
সরেজমিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
গতকাল রবিবার চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখানবাজার এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নবনির্মিত এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে প্রাইভেটকার, সিএনজি ও মালবাহী ট্রাক চলাচল করছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে কোনো গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়নি।
যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন নামে ১০ নম্বর পরিবহনের এক বাসচালকের সঙ্গে কথা হয় বেলা সোয়া ৩টার দিকে। এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে বাস চলাচল করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে তো সাধারণ যাত্রীদের চলাচলের জন্য বানানো হয়নি। প্রাইভেট গাড়িতে থাকা বড়লোকদের চলাচলের জন্য বানানো হয়েছে।’
তার কারণ জানতে চাইলে বাসচালক বলেন, ‘আমাদের ১০ নম্বর বাস লালখানবাজার থেকে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাই, তাহলে আমাদের তো সরাসরি পতেঙ্গায় গিয়ে নামতে হবে। মাঝপথে তো আমাদের যাত্রীদের ওঠানামার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সেক্ষেত্রে সরাসরি পতেঙ্গায় গিয়ে নামা তো সম্ভব নয়। আমাদের তেল খরচও তো উঠবে না। তাই এই ১০ নম্বর সড়ক দিয়েই আমরা চলাচল করছি।’
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর নগরীর লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে উদ্বোধন করা হলেও তখন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। উদ্বোধনের নয় মাস পর গত বছরের আগস্ট মাসের শেষদিকে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হয়।
সিডিএর তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের অনুমোদনের সময় এক্সপ্রেসওয়ের ৯টি জংশনে ২৪টি র্যাম্প নির্মাণের কথা ছিল। পরবর্তীতে তা কমিয়ে ১৫টি করা হয়। তবে সর্বশেষ ছাত্র-গণঅভুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আরও ছয়টি কমিয়ে এখন নগরীর বিভিন্ন জংশনে ৯টি র্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
বিশেষজ্ঞদের মতে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের আগে যথাযথভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডিও করা হয়নি। তাই র্যাম্প নির্মাণ ছাড়াই এক্সপ্রেসওয়েটি গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। নগরীর লালখানবাজার এলাকা থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে যেই যানবাহন ওঠে, সেই যানবাহনকে পতেঙ্গায় গিয়ে নামতে হয়। এক্সপ্রেসওয়েটিতে র্যাম্প না থাকায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার কোনো অংশে যানবাহন নামার সুযোগ নেই। ফলে নগরীর যানজট নিরসনে খুব একটা কাজে আসছে না।
২০১৭ সালে সিডিএর নেওয়া এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এক্সপ্রেসওয়েটির নকশা যথাযথভাবে না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন। প্রায় সময় তিনি এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ সঠিকভাবে না হওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও বলতেন। গতকাল সন্ধ্যায় ত্রুটিপূর্ণ এক্সপ্রেসওয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোবাইলে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সিডিএর এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে কী বলব? আগে তো অনেক বলেছি। এখন যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন, তাই কিছু বলতে চাই না। তবে এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে গণপরিবহন-কেন্দ্রিক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। এত বড় বাজেটের এই প্রকল্পটি সকল স্টেকহোল্ডারের কাজে আসতে হবে। সেইভাবে পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।’
নকশাগত ত্রুটি : গোড়াতেই ভুল
প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হলেও ডিটেইল ডিজাইন করা হয়নি। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে এক্সপ্রেসওয়ের মূল অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তন করতে হয়, যার ফলে নতুনভাবে ভূমি অধিগ্রহণ, বিদ্যুতের লাইন স্থানান্তর, ইউটিলিটি সরিয়ে নেওয়ার মতো ব্যয়বহুল কাজ করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয়েছিল তখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হলেও ডিটেইল ডিজাইন করা ছিল না। পরে ড্রয়িং, ডিজাইন চূড়ান্ত করার পর বাস্তবায়নকাজ শুরু হয়। ওই পর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে অ্যালাইনমেন্ট (এক্সপ্রেসওয়ের স্থান) পরিবর্তন হয়ে যায়। এর ফলে ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তর এবং ওপরে থাকা বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচে নিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দেরি হয়। সেই সঙ্গে প্রথম সংশোধনীর সময় ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই ব্যয় বাড়ানোর আগে মন্ত্রণালয় থেকে একটি নিরপেক্ষ কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির প্রতিবেদন, প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং পরিকল্পনা কমিশন খতিয়ে দেখার পর তখন ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। বাস্তব কারণেই এমনটি হয়েছিল। এখন যে মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে, এটিও যৌক্তিক। মূল ব্যয়ের তুলনায় যে বাড়তি খরচ হয়েছে, সেটিকে অপচয় বলার সুযোগ নেই।
যেসব কারণে ব্যয় বাড়ছে
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রস্তাবিত ডিপিপিতে বলা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদনের সময় ১৪টি র্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যা পরবর্তীতে ১৫টিতে উন্নীত করা হয়। প্রথম সংশোধনীর সময় ছয়টি র্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলেও, পরে দেখা যায় আরও নয়টি র্যাম্প অপরিহার্য। এ কারণে ৪৮৪ মিটার র্যাম্প বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খরচ বেড়েছে।
এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, নির্ধারিত স্থানের মাটির গুণগত মান দুর্বল। ফলে পিয়ার ফাউন্ডেশনের ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়, যা অতিরিক্ত ব্যয় বাড়িয়েছে।
পাশাপাশি প্রকল্পে নতুন কার্যক্রম হিসেবে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২.৫৪ কিলোমিটার উঁচু নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ এবং শব্দদূষণ কমাতে শব্দ প্রতিবন্ধক বসানোর কাজ যুক্ত হয়েছে। ফলে প্রকল্প ব্যয় আরও বেড়েছে। এ ছাড়া তিন বছরের কাজ আট বছরে গড়ানোর কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রীর দাম, মজুরি ব্যয় এবং বিভিন্ন নির্মাণকাজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণেও খরচ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।