মোহনগঞ্জের হাওর
হাফিজুর রহমান চয়ন, হাওরাঞ্চল ( নেত্রকোণা)
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:১৭ পিএম
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া থেকে ডিঙ্গাপোতা হাওরের ভেতর দিয়ে গাগলাজুর পর্যন্ত সাবমার্সিবল রোড বা ডুবো সড়ক পুনর্নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রায় ২৮ কোটি টাকার এই কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সিমেন্টের পরিমাণ কম দিয়ে কালো রঙের ভিটেমাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সড়কটি বেশি দিন টিকবে না। এ ছাড়া কাজের গতি এতই ধীর যে গত সাত মাসে ১০ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। ফলে চলতি শুকনো মৌসুমে কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ-গাগলাজুর সড়কের তেঁতুলিয়া থেকে গাগলাজুর বাজার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ ডুবো সড়ক প্রশস্ত করা ও পুনর্নির্মাণ কাজে গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী এলজিইডির ২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৩১০০ টাকার কাজটি পায় এমএস বিল্ডার্স নামের কুমিল্লার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, এমএস বিল্ডার্স কাজের দায়িত্ব পেলেও কাজটি বাস্তবায়ন করছেন নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জের মফিদুল ইসলাম ওরফে ওয়াসীম নামের এক ঠিকাদার। ২০২৪ সালের ৩ জুলাই কাজ শুরু করে চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু সাত মাসেরও বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন এবং সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার বেশ কিছু এলাকার লোকজন নৌপথে গাগলাজুর বাজারে এসে সেখান থেকে সড়ক পথে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন। পুরোনো সড়কটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু করা হলেও চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন শত শত যাত্রীবাহী মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ, লরি চলাচল করছে। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
খালিয়াজুড়ি উপজেলার পাতরা গ্রামের সঞ্জু কুমার সরকার (৬৯) বলেন, আগে মোটরসাইকেলে করে মোহনগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসতে সময় লাগত মাত্র ৪০ মিনিট। আর এখন ঝুঁকিপূর্ণ পথে পৌনে ২ ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছতে হয়। তিনি বলেন, এই সড়ক দিয়ে একদিন যাতায়াত করলে শরীরে ব্যথা কমাতে তিন-চার দিন বিশ্রামে থাকতে হয়। ধুলাবালিতে চেহারা এমন হয় যে, চেনার উপায় থাকে না। এ ছাড়া কাজের মান যেমন খারাপ, গতিও খুবই ধীর।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার আমানিপুর গ্রামের আবারক মিয়া (৫৫) বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থাইক্যা আমাদের এলাকার লোকজন এই পথে মোহনগঞ্জ হইয়া রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে যাওয়া-আসা কইরা আইতাছি। কিন্তু এবার সড়কটি পুনর্নির্মাণের কাজ চললেও বিকল্প সড়ক না থাকায় অনেক কষ্ট কইরা দ্বিগুণ সময়ে যাতায়াত করতে হইতাছে।’
সড়কসংলগ্ন চাঁদপুর গ্রামের আবুল মিয়া বলেন, ‘কাজের শুরু থেকেই ঠিকাদার রাস্তার দুই পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণের বাজে ইট ও সিমেন্টের সঙ্গে কালো রঙের ভিটি বালু ব্যবহার করছেন। আমরা নানাভাবে এর প্রতিবাদ করেও তেমন ফল পাচ্ছি না।’
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সোয়াইব ইমরান বলেন, ‘কাজের শুরুতেই সড়কের পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণে কিছু নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হচ্ছিল। খবর পেয়ে আমরা সেখান থেকে ওইসব নিম্নমানের ইট অপসারণ করি। এ ছাড়া সপ্তাহখানেক আগে সড়কের নওগাঁ নামক স্থানে বিকালে এ কাজের দায়িত্বে থাকা আমাদের তদারকি কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকা থেকে চলে আসার পর নাকি মিস্ত্রিরা কয়েক ফুট গাইড ওয়াল নির্মাণকাজে ভিটি বালু ব্যবহার করেন। খবর পেয়ে পরদিন আমরা সেখানে গিয়ে ওই স্থানটুকুও ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্মাণ করাই।’
সড়কে চলাচলকারী যাত্রীবাহী মোটরসাইকেলচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সড়কটি ভাঙার আগে পাশেই একটি বিকল্প সড়ক করে দিলে যাত্রী নিয়ে আমাদের এত কষ্ট পেতে হতো না। অতিরিক্ত ঝাঁকুনির ফলে ঘন ঘন নষ্ট হচ্ছে মোটরসাইকেল।’
গাগলাজুর ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবার এ সড়কটির পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ঠিকাদার নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে ধীরগতিতে কাজ করছেন। এসব অনিয়মের কথা উপজেলা সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় উত্থাপন করেছি।’ তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্তত সড়কটির তেঁতুলিয়া থেকে নওগাঁ পর্যন্ত অংশের কাজ যদি শেষ করা না হয়, তবে বৈশাখ মাসে আমাদের হাওর এলাকার কৃষকের বছরের একমাত্র বোরো ফসল পরিবহনের ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকাদার মফিদুল ইসলাম ওরফে ওয়াসীম বলেন, ‘নির্মাণকাজে আমরা কোনো অনিয়ম করিনি। এ কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছি। তবে আমরা প্রথমে যে ভাটা থেকে ইট কিনি, সেখান থেকে এক নম্বর ইটের মধ্যে বেশ কিছু নিম্নমানের ইট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পরে উপজেলা প্রকৌশলীর নির্দেশে সেগুলো আমরা প্রকল্প এলাকা থেকে অপসারণ করে নেই। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে কয়েক ফুট স্থানে গাইড ওয়াল নির্মাণে সিমেন্টের পরিমাণ কম দেওয়া হয়। পরে সেটিও ভেঙে নতুন করে করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘গাইড ওয়ালের কাজ শেষ করার পর ঢালাইসহ বাকি সব কাজ মেশিনের মাধ্যমে দ্রুতই সম্পন্ন করা হবে।’
প্রকৌশলী সোয়াইব ইমরান বলেন, ‘দ্রুত এ সড়কের কাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদারকে আমরা একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কাজটি যথাযথ নিয়ম মেনে শেষ করতে সর্বাত্মক নজরদারি রাখছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জুয়েল আহমেদ বলেন, ‘আমি শিগগিরই এ সড়কটি পরিদর্শন করব। পরে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’