শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:২৬ পিএম
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:৩৩ পিএম
ফাল্গুন আসতে এখনো ঢের বাকি। তবে এরই মধ্যে এবার আগাম আমের মুকুল এসেছে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার গাছে গাছে। আর সব গাছে মুকুল আসতে সময় লাগবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত তীব্র শীতে মুকুলের ক্ষতি না হলেও শঙ্কায় রয়েছেন আমচাষিরা। গত এক সপ্তাহের তীব্র শীতের পাশাপাশি ঘন কুয়াশায় মুকুলের ক্ষতির শঙ্কা দেখছেন চাষিরা।
গত বছর শুরু থেকেই শীতের মাত্রা বেশি থাকায় গাছগুলোতে মুকুল ঠিকমত বের হতে পারেনি। যার ফলে রাজশাহীতে আমের ফলন আশানুরূপ হয়নি। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এক মৌসুমে আম গাছে মুকুল কম আসলে পরের বার মুকুল বেশি আসে। এজন্য এবার মাঘের শুরুতেই বাগানগুলোতে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে আগাম আমের মুকুল।
আম চাষিরা বলছেন, গত বছর শুরু থেকেই শীতের মাত্রা বেশি থাকায় গাছগুলোতে মুকুল ঠিকমত বের হতে পারেনি। এ বছর শীত কম থাকায় আগাম গাছে মুকুল এসেছে। এ মুকুল টিকে থাকলে বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে। আগাম আম বেশি দামে বিক্রিও করা যাবে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে হঠাৎ ঘন কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে। এতে মুকুল পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য শীতের কষ্ট সহ্য করেও মুকুল বাঁচাতে গাছের বাড়তি পরিচর্যা করছেন তারা।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই আবহাওয়াগত ও জাতের কারণে মূলত আমের মুকুল আসতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশার কবলে না পড়লে এসব গাছে আগাম ফলন পাওয়া যাবে। তবে ঠিকমত পরিচর্যা না করলে এসব মুকুলে ফলন মিলবে না। কুয়াশার পর রোদ থাকায় নষ্টের পরিবর্তে মুকুল আরও সতেজ হবে। এজন্য কিছু ছত্রাক জাতীয় কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে চাষিদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজশাহী জেলার ৯ উপজেলাস ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ টন আম। কিন্তু গাছে মুকুল কম আসার কারণে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ বছর জেলার প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টন। গত বছর ভাল দাম পাওয়ায় এ জেলার চাষিরা আম থেকে আয় করেছিল প্রায় ১ হাজার ৫২৮ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ টাকা।
রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, পুঠিয়া ও পবা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবুজ পাতা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে মুকুল। পরিমাণে অল্প হলেও সোনারাঙা সেই মুকুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। তবে অধিকাংশ গাছে এখনো মুকুল আসেনি। চাষিরা গাছে ঠিকমত মুকুল নিয়ে আসতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
চারঘাটের রাওথা এলাকার আম চাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গতবার চার বিঘা বাগানে আম গাছের পরিচর্যা করে ৫৫ হাজার টাকা খরচ করলেও মাত্র ২০ হাজার টাকার আম পেয়েছিলাম। এবার শীত কম থাকায় কিছুটা আগেই মুকুল এসেছে। সবগুলো গাছেই কম বেশি মুকুল বের হওয়া শুরু হয়েছে। গত বারের লোকসান পুষিয়ে নিতে এবার গাছের পরিচর্যায় বেশি সময় পার করছি।’
বাঘা উপজেলার তুলশিপুর এলাকার আম চাষী আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমার সাড়ে চার ছয় বিঘা আম বাগান রয়েছে। গত বছর অর্ধেক গাছে ভাল মুকুল আসলেও ঘন কুয়াশায় ও শীতে পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এবার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পুরো বাগানেই মুকুল আসবে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ প্রচণ্ড কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। গতবারের মত পরিণতি হয় কি না তা ভেবে চিন্তিত। এ কারণে বাড়তি সময় দিচ্ছি আমের বাগানে।’
আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা এবং আগাম পূর্বাভাসে মুকুলের নিয়ে চাষিদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়েছে। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, এ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গত ১০ জানুয়ারি ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গত ২৯ জানুয়ারি ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি, ৩০ জানুয়ারি ১২ ডিগ্রি ও গতকাল ৩১ জানুয়ারি রাজশাহীর তাপমাত্রা ছিল ১১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত তিন দিন ধরে তাপমাত্রা কমছে। আগামী কয়েকদিন শীত ও কুয়াশা এরকমই থাকবে জানিয়েছেন তিনি।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু সাহেদ বলেন, ‘এখন যে মুকুল গুলো এসেছে সেগুলো ফেব্রুয়ারির প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহে ফোটা শুরু হবে। তখন শীত ও কুয়াশা থাকলে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুকুল ফোটার সময় ছত্রাকনাশক ও ইমিডা ক্লোরোপিড গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই গত বছর মুকুল কম এসেছে এজন্য এ বছর রাজশাহী বেশি পরিমাণ মুকুল আসবে।’
জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার রয়েছে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে। বানেশ্বর বাজার আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমকে কেন্দ্র করেই রাজশাহীর অর্থনীতি অবর্তিত হয়। গত বছর ফলন কম হওয়ায় আমের দাম বেশি থাকলেও এ ফলের উৎপাদন কাজের সাথে জড়িতরা লাভবান হতে পারেনি। এ বছর সব এলাকা থেকেই খবর পাচ্ছি গাছে বেশি পরিমাণ মুকুল আসছে। অনেক ব্যবসায়ী মুকুল দেখে বাগান চুক্তিতে আম কেনাও শুরু করেছেন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী জেলার উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘রাজশাহী কিছু কিছু গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। যেসব মুকুল আসছে এগুলো আগাম জাতের। তবে সব পরিপূর্ণ মুকুল আসতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। গত বছরের তুলনায় এবার বেশি মুকুল আসবে বলে মনে হচ্ছে। সে অনুযায়ী পরিচর্যা করতে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’