হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৪ পিএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫০ পিএম
চট্টগ্রাম বন্দর
অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের জেআর ইয়ার্ডে থাকা একটি কন্টেইনার থেকে ২৭টি গেমিং ল্যাপটপ গায়েবের অভিযোগ ওঠার তিন মাসের মাথায় এবার বন্দরে ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা’র মধ্যেই ঘটেছে প্রকাশ্য চুরির ঘটনা। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছেÑ বন্দরের একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার থেকে এক ব্যক্তি একটি বস্তা ছুড়ে ফেলছে নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাইরে। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে আগে থেকে অবস্থান করা আরেক ব্যক্তি বস্তাটি নিয়ে চলে যাচ্ছে।
বন্দরের মতো সুরক্ষিত এলাকায় এভাবে প্রকাশ্যে চুরির ঘটনায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বন্দরের মতো একটি কেপিআই এলাকায় যদি এভাবে প্রকাশ্যে চুরির ঘটনা ঘটে, তাহলে ব্যবসায়ীরা যাবেন কোথায়? এই চোর চক্রের সঙ্গে নিশ্চয়ই বন্দরের ভেতরের লোকজনের যোগসাজশ রয়েছে। আর শর্ষের মধ্যে এই ভূতের অবস্থান বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বন্দর হচ্ছে সিকিউরিটি ওয়ান পর্যায়ের একটি কেপিআই। এর মানে হলোÑ বন্দরে সবকিছু সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যে থাকে। এ রকম একটি সুরক্ষিত এলাকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে বস্তায় ভরে মালামাল বাইরে ফেলে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চোর। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। কারণ এতে শুধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে একটি বিরূপ বার্তা যাচ্ছে।’
প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘সিকিউরিটি টাওয়ারে উঠে চোর মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় সিকিউরিটি গার্ড কোথায় ছিল? ওয়াচ টাওয়ার ব্যবহার করেই যদি চুরির ঘটনা ঘটে, তাহলে বন্দরের নিরাপত্তা থাকে কোথায়?’
দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার হলো চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই হয় এই বন্দর দিয়ে। সে কারণে বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাও অত্যন্ত সুরক্ষিত থাকার কথা। সেখানেই উঠছে একের পর এক চুরির অভিযোগ।
সর্বশেষ দুদিন আগে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বন্দরের তিন নম্বর গেটের পাশে ওয়াচ টাওয়ার থেকে এক ব্যক্তি একটি বস্তা ছুড়ে ফেলছে নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাইরে। আরেকজন সেই বস্তাটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ ঘটনায় গত সোমবার একজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে অক্টোবর মাসে বন্দরের জেআর ইয়ার্ডে থাকা একটি কন্টেইনার থেকে ২৭টি গেমিং ল্যাপটপ গায়েবের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় কন্টেইনারটি খালাসে নিযুক্ত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান জানায়, ঢাকার স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেডের আমদানি করা ল্যাপটপবাহী দুটি কন্টেইনার গত ১৫ অক্টোবর পুরোপুরি কায়িক পরীক্ষা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এরপর সব পক্ষের উপস্থিতিতে বুলেট সিল লাগিয়ে কন্টেইনার দুটি নিরাপদ হেফাজতে হস্তান্তর করা হয়। অথচ ২২ অক্টোবর কন্টেইনার খুলে গণনায় দেখা যায়Ñ ৬৫টি দামি গেমিং ল্যাপটপের মধ্যে ২৭টিই গায়েব। চুরি হওয়া এসব ল্যাপটপের দাম প্রায় ৩৮ লাখ টাকা।
বন্দরের অভ্যন্তরে রাখা কন্টেইনার খুলে প্রায়ই পণ্য চুরির ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তারা বলছেন, সাধারণত শিপমেন্টের আগে রপ্তানি কন্টেইনার বন্দরে পাঠানো হয়। কোনো কারণে শিপের শিডিউল দেরি হলে কন্টেইনার ইয়ার্ডেই থাকে। এ সময় বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেই বাড়তি নিরাপত্তার মধ্যেই কন্টেইনারের সিল ভেঙে পণ্য নিয়ে যায় চোর চক্র। একইভাবে আমদানিপণ্যের কন্টেইনারগুলোর সিল ভেঙেও মালামাল চুরির ঘটনা ঘটছে।
এসব ঘটনায় বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় ফাঁকি দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বন্দর একটি সুরক্ষিত এলাকা, যেখানে নিরাপত্তা কার্ড ইস্যু করা ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। পুরো এলাকা থাকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। তারপরও নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে কীভাবে বন্দরে চোর প্রবেশের সুযোগ পায়?
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখার আগেও এ ধরনের চুরির ঘটনার বিষয়ে আমরা জানতাম। বন্দর কর্তৃপক্ষকে বারবার বলে এলেও সেভাবে কোনো প্রমাণ দিতে পারিনি। এবার ভাইরাল হওয়া চুরির এই ভিডিও একটা বড় প্রমাণ হয়ে দেখা দিয়েছে। চুরির এ ঘটনা দেখে আমরাও উদ্বিগ্ন। কারণ আমদানিকারকের পণ্য এভাবে চুরি হলে আর ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য বুঝিয়ে দিতে না পারলে আমদানিকারক তখন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে চোর সাব্যস্ত করে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলছি যেÑ বন্দরে চুরির ঘটনা রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কখনই চাইব না যে বন্দরের মতো সুরক্ষিত এলাকায় এ ধরনের চুরির ঘটনা ঘটুক। আমরা মনে করি, বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তারা অত্যন্ত সৎ ও কর্মনিষ্ঠ। কিন্তু শর্ষের ভেতরে কোথাও না কোথাও ভূত আছে। না হলে যেখানে নিরাপত্তাকর্মী থাকার কথা সেখানে চোর যায় কীভাবে? আমরা চাই বন্দর কর্তৃপক্ষ সেটি তদন্ত করে জড়িতদের বের করে আনুক।’
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এমন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাব্যবস্থায় এমন ত্রুটিতে আমরা উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। বন্দরে যদি পণ্যের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে? আমরা আমাদের পণ্যের নিরাপত্তা চাই।’
চট্টগ্রাম বন্দরের ফোকাল পারসন বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক অবশ্য বিষয়টিকে সামগ্রিক চিত্রের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে নারাজ। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে একটি ছিঁচকে চুরির ঘটনা। ওরা একটি রেফার্ড কন্টেইনারের কম্প্রেসার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনার ভিডিও দেখে একজনকে আটক করে আমরা পুলিশে দিয়েছি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চোর কীভাবে বন্দরে প্রবেশ করেছে সেটি আমরা খতিয়ে দেখছি। খোঁজ নিয়ে যত দূর জেনেছিÑ ওই ওয়াচ টাওয়ারের পাশে আমদানি পণ্যভর্তি কোনো কন্টেইনার ছিল না। যে কারণে ওই পোস্টে সে সময় কোনো সিকিউরিটি গার্ড নিযুক্ত ছিল না।’