এমএ এহসান রিয়াজ, রামগতি-কমলনগর (লক্ষ্মীপুর)
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০৭ পিএম
রামগতি পৌরসভায় পরিবারভিত্তিক শৌচাগার নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের গোপী মোহন দাশের বাড়িতে নির্মাণাধীন শৌচাগার। প্রবা ফটো
নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে যেনতেনভাবে শৌচাগার নির্মাণ করে গেছেন ঠিকাদার। রিং বসানোর আগেই বেশিরভাগ ভেঙে গেছে। পাশে রিং দিয়ে তৈরি ট্যাংকে দেওয়া হয়নি পাইপ সংযোগ। এ ছাড়া পানি তোলার জন্য বরাদ্দের বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে গেছে নিজ খরচে পানির পাম্প বসিয়ে সংযোগ করে নেওয়ার জন্য।
কথাগুলো বলেন পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও শৌচাগার বরাদ্দ পাওয়া সুফলভোগী আবদুস ছালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের ৩০টি পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটারি (বিএমডব্লিউএসএসপি) প্রকল্পের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভায় ইমপ্রুভড হাউসহোল্ড শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে গৃহভিত্তিক ৭০০ আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে এসব শৌচাগার নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এতে শৌচাগারের স্থায়ীত্ব নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে সুফলভোগীদের মধ্যে।
কার্যাদেশ সূত্রে জানা যায়, সিডিউল অনুযায়ী প্রতিটি শৌচাগার নির্মাণের শুরুতে তিন ইঞ্চি সিসি ঢালাই, ১০ রদ্দার ইটের গাঁথুনিতে প্রতি রদ্দায় ৪৫টি ইট, সাত ফুট দৈর্ঘ্যের পাঁচ ইঞ্চির দেয়াল, ছাদে চার ফুট দুই ইঞ্চি ও ছয় ফুট দুই ইঞ্চির ২৬ পিস রড দিয়ে তিন ইঞ্চি পুরু ঢালাই, ১২টি রিং স্লাব, একটি ৩০০ লিটারের পানির ট্যাংক ও বৈদ্যুতিক মোটরের সমন্বয়ে প্রতিটি শৌচাগারের নির্মাণ ব্যয় ৭০ হাজার ৩০০ টাকা বরাদ্দে কার্যাদেশ পায় শামীম এন্টারপ্রাইজ, একতা ট্রেডার্স, মুক্তা এন্টারপ্রাইজ, তরুণ এন্টারপ্রাইজ, ফাতেমা এন্টারপ্রাইজসহ প্রায় ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব শৌচাগারের নির্মাণকাজ প্রকৃত ঠিকাদার আড়ালে থেকে কমিশনে কাজ করাচ্ছেন তাদের সিন্ডিকেটের অন্য লোক দিয়ে। প্রতিটি শৌচাগারের বিপরীতে ৭০ হাজার ৩০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও দায়সারাভাবে কাজ করা হচ্ছে। ঠিকাদার থেকে সাব-ঠিকাদার কাজ নিচ্ছেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। ফলে স্টেকহোল্ডাররা সিডিউল অনুযায়ী মানসম্মত শৌচাগার পাচ্ছেন না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মুক্তা এন্টারপ্রাইজ, তরুণ এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে পাওয়া শৌচাগার নির্মাণকাজ সাব-ঠিকাদার হিসেবে বাগিয়ে নিয়ে কাজ করছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজমিস্ত্রি। এদের মধ্যে দিদার মিস্ত্রি ৫০টি, জসিম ৪০টি, ইউসুফ ৩০টি, সাইফুল ১২টি, কামাল ১২টি ও বেলাল মিস্ত্রি ১২টির কাজ করছেন। এর বাইরে অন্য শৌচাগারের কাজ কোন ঠিকাদার পেয়েছেনÑ জানতে চাইলে উপসহকারী প্রকৌশলী তানভির হোসেন তথ্য দিতে রাজি হননি।
এ প্রকল্পের অধীনে পৌরসভায় মোট কতটি শৌচাগার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে কয়টি বাস্তবায়ন করা হয়েছেÑ তার সঠিক তথ্য জানার জন্য উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ে কিংবা পৌরসভা কার্যালয়ে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেও তা পাওয়া যায়নি।
এদিকে মাঠপর্যায়ে নেই কোনো ধরনের তদারকি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী তানভিরের যোগসাজশে ঠিকাদার ও মিস্ত্রিরা মিলেমিশে এমন অনিয়ম করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সপ্তাহখানেক ধরে ৩০ জনেরও বেশি সুফলভোগীর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পৌরসভায় এ পর্যন্ত যেসব গৃহভিত্তিক শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে, তার সবগুলোতে পুরোনো ব্যবহৃত খোয়াসহ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকালে গৃহস্থের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে দুই থেকে তিন ব্যাগ সিমেন্ট। মোটরের জন্য পানির পাম্প না বসিয়ে শুধু মোটরটি পরিবারকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের দেওয়া ৩০০ লিটারের পানির ট্যাংকগুলো অখ্যাত কোম্পানির ও নিম্নমানের। বেশিরভাগ শৌচাগারে সিসি ঢালাই করা হয়নি। এ ব্যাপারে একতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. হেলাল বলেন, ‘আমি ১৪টি শৌচাগার নির্মাণের কাজ করছি। কোনো অনিয়ম করিনি। তবে অন্য ঠিকাদাররা অফিস ম্যানেজ করে মাত্র ছয় ব্যাগ সিমেন্ট এবং মানহীন ইট, সিসি ঢালাই ছাড়া কাজ করেছেন। এতে তারা মাটির নিচে ১০ ইঞ্চি গাঁথুনি না দিয়ে তিন থেকে সাড়ে ৩০০ ইট চুরি করেছেন।’ একাধিক স্থানে শৌচাগার নির্মাণ করার পর তা ভেঙে পড়েছে বলে জানান তিনি।
একইভাবে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কমিশনে কাজ করা দিদার, জসিম, ইউসুফ, সাইফুল ও কামালের দাবি, ঠিকাদারের হয়ে নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। উপজেলা প্রকৌশলী নিয়মিত দেখভাল করছেন। কাজে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না।
মুক্তা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. রিপন বলেন, ‘আমাদের লাইসেন্সে কাজ নিয়েছেন তারা। কাজের বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। অনিয়মের বিষয়ে আমাকে প্রকৌশলী জানিয়েছেন।’
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী তানভির হোসেন বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। তবে এ প্রকল্পে ৭০০ শৌচাগার অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫০টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলমান রয়েছে ৩৭০টির।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঝন্টু বিকাশ চাকমার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিলকিছ আক্তার বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি জানানোর জন্য ধন্যবাদ। সরেজমিনে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’