হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:০৯ এএম
এসি ল্যান্ড তারিকুল
সিরাজগঞ্জের বালুমহাল থেকে ব্যবসার উদ্দেশে বালু কেনেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের এক ব্যক্তি। মজুদ করে রাখা প্রায় ১০ কোটি টাকার সেই আস্তর (প্লাস্টার) বালুকে অবৈধ বালু হিসেবে জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে গোপন নিলামের মাধ্যমে বালুগুলো প্রায় ৪৯ লাখ টাকায় নিলামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে এসি ল্যান্ড তারিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
গত ৬ জানুয়ারি উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক মাসুদের নিজস্ব ও লিজ নেওয়া জমিতে অভিযান পরিচালনা করেন এসিল্যান্ড তারিকুল ইসলাম। পরের দিন ৭ জানুয়ারি ১০ কোটি টাকার বালু ৪৮ লাখ ৩৩ হাজার ৬৮০ (ভ্যাট ব্যতীত) টাকায় গোপন নিলামে স্থানীয় জহুরা এন্টারপ্রাইজের কাছে বিক্রি করা হয়।
এদিকে গোপনে নিলামের বিষয়ে জানাজানি হলে উপজেলা ও জেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন সুধীমহল।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে উপজেলা সার্ভেয়ার রফিকুল ইসলাম এবং প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামকে বালুর ধরন ও পরিমাপের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্থানীয় ও ভুক্তভোগীর মতে, সেখানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট বালু ছিল। সিরাজগঞ্জের মেসার্স এস কনস্ট্রাকশন থেকে এই বালু কেনা হয়েছেÑ এমন অসংখ্য রসিদ উপস্থাপন করেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ জানান, প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট প্লাস্টার (নির্মাণকাজে ব্যবহৃত) বালুকে ২৬ লাখ ১২ হাজার ৮০০ ঘনফুট ধরে ভিটিবালু দেখিয়ে নিলাম দেওয়া হয়েছে। যার মূল্য ধরা হয়েছে ১ টাকা ৮৫ পয়সা ঘনফুট। অথচ প্রতি ঘনফুট বালু সাধারণত বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৪ টাকায়।
নিলাম আইন অনুযায়ী, নিলাম পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিলাম ডাকের কমপক্ষে ৭ কার্যদিবস আগে ২টি জাতীয় দৈনিক এবং ১টি স্থানীয় দৈনিকে নিলামের বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে লিখিত চিঠি প্রদান ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ওয়েবসাইটেও তা প্রকাশ করতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে নিলামের তারিখ, ক্যাটালগ প্রদানের তারিখ, ক্যাটালগের মূল্য, পণ্য পরিদর্শনের তারিখ-সময়, জামানতের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকতে হবে। এবং পণ্য পরিদর্শনের তারিখ নিলাম অনুষ্ঠানের কমপক্ষে ২ কার্যদিবস আগে হতে হবে। কিন্তু এসব আইনের কোনোকিছুই মানা হয়নি জব্দকৃত ওই বালু নিলামের ক্ষেত্রে।
পলশিয়া গ্রামের আলা উদ্দিন বলেন, কয়েক মাস আগে সিরাজগঞ্জ মহাল থেকে বালু কিনে এনে চেয়ারম্যান তার নিজের জায়গা ও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে বালু রেখেছে। প্রতি সিএফটি বালু কেনা পড়েছে ৮ টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন ঘাটে প্রতি সিএফটি বালু বিক্রি হচ্ছে ১২-১৪ টাকা। অথচ এসিল্যান্ড এর দাম ধরেছেন ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
একই এলাকার নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক এলাকায় থাকি। কোনো মাইকিং করা হলে কেউ না কেউ শুনত বা জানত। এ ছাড়া কোনো পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে সেটিও জানা যেত। এসিল্যান্ডের অফিসে নিলামের বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে রাখলেও জানা যেত। ঘটনাস্থলে কোনো নিলামের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি। বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে গোপনে করা হয়েছে।
উপজেলা সহকারী (ভূমি) অফিসের সার্ভেয়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনটি বালুর স্তূপের মধ্যে একটি স্তূপের বালু পা দিয়ে পরিমাপ করেছি। অন্য দুটি শুধু দেখেছি। এতে আনুমানিক সব মিলিয়ে ২৬ লাখ ঘনফুট নির্ধারণ করেছি। অন্যান্য বিষয় এসিল্যান্ড স্যার জানেন।
যদিও এক দিন পরেই তার বক্তব্য পরিবর্তন করেন সার্ভেয়ার। নতুন বক্তব্যে তিনি বলেন, ফিতা ও চেইন টেনেই বালু পরিমাপ করেছি। এ কাজে তাকে আরও দুজন সহায়তা করেছে। তবে, তিনটি বালুর স্তূপের কোনোটিতেই মাপামাপি হয়নি বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, বালুর ধরন সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছিল। পরে আমার দপ্তরের লোক পাঠালে সে নমুনা নিয়ে আসে। নমুনা দেখে ভিটিবালু মনে হয়েছে। আমি সেটিই বলেছি।
ভূঞাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম রেজাউল করিম বলেন, কবে, কোথায়, কীভাবে বালু নিলাম হয়েছে তা জানা নেই। তা ছাড়া নিলাম অনুষ্ঠানের মৌখিক বা লিখিত কোনো চিঠি পাইনি।
এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তারিকুল ইসলাম বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন অনুযায়ী বালু জব্দ করে নিলাম দেওয়া হয়। নিষিদ্ধ বাল্কহেডের মাধ্যমে বালু পরিবহন করে সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছিল তাই এটি অবৈধ। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি জমিতে মজুদও অবৈধ। এ ছাড়া বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন মোতাবেক জনদুর্ভোগ ও পরিবেশ দূষণ করায় এটিও অবৈধ ছিল। কোনো ব্যক্তি জমিতে বালু রাখলেও প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন। সুতরাং আইনের ব্যত্যয় হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বালু মেপে তারপর নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শফিকুল ইসলাম বলেন, বালু আইনের বিধি মোতাবেক তিনি নিলাম করেছেন। যদি সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি আপিল করতে পারবেন। সেই সুযোগ তার রয়েছে। এটির ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্তে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কারও দোষ প্রমাণ হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।