মৌলভীবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:০১ পিএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫২ পিএম
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও মৌলভীবাজারের শেরপুরের হামরকোনা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা। শেরপুরের কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় ২০০ বছর ধরে এ মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
গত রবিবার (১২ জানুয়ারি) রাত থেকে শুরু হওয়া এবারের মেলাটির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ভোরে। এবার মেলায় মাছসহ অন্যান্য সামগ্রী বেচা-কেনা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা- এমনটি জানিয়েছেন মেলার ইজারাদার মো. কর্নেল আহমেদ। মেলায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বড় বড় সব বাঘাইড় মাছ। সবচেয়ে বড় বাঘাইর মাছের ওজন ছিল ১০০ কেজি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজারের ২ নম্বর মনুমুখ ইউনিয়নের মনুমুখ বাজারে ঐতিহ্যবাহী এ মাছের মেলার গোড়াপত্তন হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে এ মেলাটি বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সত্তরের দশকে নদী ভাঙ্গনের কারণে মনুমুখ বাজারটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। ফলে মাছের মেলাটি এখানে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তখন মাছের মেলাটি মনুমুখ বাজার থেকে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এ তিন জেলার মোহনা মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর বাজারের কাছাকাছি ১ নম্বর খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা গ্রামে কুশিয়ারা নদীর তীরে স্থানান্তর করা হয়।
এবারের মাছের মেলায় মৌলভীবাজার জেলার কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওর, কাওয়াদিঘি হাওর, হাইল হাওর ও সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ভাটি জেলা কিশোরগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা দেশীয় প্রজাতির বাঘাইড়, চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, গজার ও আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন।
ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলার ইজারাদার মো. কর্নেল আহমেদ বলেন, ‘এবারের মূল মেলা সোমবার সকাল থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও রবিবার রাত থেকেই মেলায় বিভিন্ন স্টলে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। প্রায় ২০০ বছরের এ মেলাটির জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কোনো জায়গা বরাদ্দ নেই। তাই ধানের জমিতেই আমাদের মেলাটি করতে হয়। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই মেলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। বিদেশ থেকেও মাছের মেলায় দেশে আসেন অনেক প্রবাসী। সবারই আগ্রহ থাকে মেলা থেকে বড় আকারের মাছ কিনে নেওয়া।’
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মৎস্য ব্যবসায়ী জমির মিয়া বলেন, ‘প্রতি বছর শেরপুরের মাছের মেলার জন্য দুই-এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ মেলায় আসেন মাছ কিনতে। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মিলনে মেলা হয়ে ওঠে জমজমাট। শুধু মৌলভীবাজার জেলা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন বিক্রেতারা আসেন, তেমনি ক্রেতারাও আসেন। এ বছর মেলায় আমি তিন লক্ষাধিক টাকার মাছ বিক্রি করেছি।’
এবারের মাছের মেলায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সপরিবারে দেশে এসেছেন সদর উপজেলার শাহাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম। সোমবার মেলার মাঠে ঘুরে ঘুরে কিনেছেন লক্ষাধিক টাকার মাছ। তিনি বলেন, ‘বহু বছর পরে এবার মাছের মেলায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশে এসেছি। বেশ কয়েকটি মাছ কিনেছি। আরও কিনব। মেলা থেকে মাছ কিনে বিতরণেও এক ধরনের আনন্দ।’
জেলার বড়লেখা উপজেলার সমাজকর্মী ইকবাল চৌধুরী ও তার পাঁচ বন্ধু মেলায় এসেছিলেন সোমবার রাতে। সবাই মাছ কিনেন মেলা থেকে। আলাপকালে ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘মাছের মেলায় দাম একটু বেশি। সুদূর বড়লেখা থেকে মোটরসাইকেলে করে মেলায় এসেছি মাছ কিনতে। মেলা থেকে মাছ কেনার আনন্দই আলাদা।’
মেলায় আগত চাঁনপুর মৎস্য আড়তের মালিক ইকবাল হোসেন জানান, ‘পদ্মা নদীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাওর-বিল, নদী থেকে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার মাছ সংগ্রহ করে মেলায় এসেছিলাম। বিক্রি করেছি আশানুরূপ। আমি গত কয়েক বছর ধরে এ মেলায় আড়ত দেই। এবার আমার আড়তে সবচেয়ে বড় মাছ ছিল ৮৫ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছ। যা ১ লাখ ৬০ হাজার বিক্রি করেছি।’
মেলা আয়োজক কমিটির সহ-সভাপতি মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছর মেলায় সিলেট বিভাগের সব হাওর-বিলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় আকৃতির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের মেলায় সারাদেশের লক্ষাধিক লোকের আগম ঘটেছে। মেলায় মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খাবার হোটেল, খৈ, মুড়ি. মুড়কি, তিলুয়া, বাতাসা, নানা রকম মৌসুমি ফল, শিশুদের খেলনা সামগ্রী, নারীদের প্রসাধনী, কাপড়চোপড়, বাঁশ-বেত ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, ঘর-সংসারের নানারকম মাটির বাসনপত্র, লোহালক্কড়ের সামগ্রী, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ নানা ধরনের পণ্য সামগ্রীর দোকান বসেছিল।’
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১ নম্বর খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু মিয়া চৌধুরীর বলেন, ‘প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে আমার ইউনিয়নের হামরকোনা গ্রামে বিশাল মাছের মেলা বসে। এ মেলায় সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের সমাগম ঘটে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের।’
মৌলভীবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আমরা তিনস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। মাদক, জুয়াসহ অসামাজিক কোন কিছু যাতে না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। সবমিলিয়ে মাছের মেলাটি যেন উৎসবমুখর হয় সে বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করেছি।’