কাওছার আহমদ, সিলেট
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৫ এএম
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:০৭ পিএম
ছবি : মো. জাকির হোসাইন
‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট।’ অব্যাহত লোকসানের মুখে টিকে থাকা কঠিন হয় পড়ছে সিলেটের চা শিল্প। বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, চোরাচালান, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকঋণ পরিশোধের উচ্চহারসহ নানামুখি সংকটে রয়েছে চা শিল্প। সংকটময় পরিস্থিতি চলতে থাকলে অনেক বাগান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এমনটা জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
চা-বাগানের মালিক ও কর্মকর্তারা জানান, ঐতিহ্যগতভাবে চা রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। যদিও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে রপ্তানি খুবই কমেছে, তদুপরি চা শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। চা শিল্পের ওপর কয়েক লাখ শ্রমিক, কর্মচারীর জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে আরও কয়েক লাখ লোক চা শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে চা শিল্প কঠিনতম পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত, যা এই শিল্পের টিকে থাকার ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে।
চা শিল্পের এই সংকটের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ সামনে এনেছেন চা-বাগানের মালিক ও কর্মকর্তারা। তারা জানান, দেশের বাইরে থেকে নিম্নমানের চা চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসা; মজুরি, তেল, রেশন, ঔষধ (অ্যাগ্রো কেমিক্যাল) ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া; কয়েকটি বড় প্যাকেটিয়ার দ্বারা নিলাম বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধের উচ্চহার। এ ছাড়া পঞ্চগড় এলাকায় নিয়মবিবর্জিত পদ্ধতিতে নিম্নমানের চা উৎপাদন করা হয়। সরকারের আইন অমান্য করে সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে চা বিক্রয়Ñ এর প্রভাব সারা দেশে পড়ছে। এসব সমস্যার তড়িৎ সমাধান না হলে অনেক বাগান বন্ধ হয়ে যাবে এবং চা শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র আরও জানায়, দেশে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ছোট-বড় ১৬৭টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সিলেট অঞ্চলে রয়েছে ১৩৫টি চা-বাগান। গেল বছরে চা-বাগানগুলোতে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ক্রমাগত লোকসানের কারণে অনেক চা-বাগানের কারখানা বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকের মজুরি দিতে না পারায় এনটিসির ১২টি বাগান তিন মাসের মতো বন্ধ ছিল। টাকার অভাবে অনেক বাগানমালিক বাগানে সময়মতো প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে পারেননি। এ ছাড়া ২০২৪ সালে বৃষ্টি হয়েছে তুলনামূলক বেশি।
এ ছাড়া বর্তমানে নির্ধারিত নিলামমূল্য ১৬০-১৭০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষ এরচেয়ে কমেও নিলামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ চায়ের উৎপাদন খরচ প্রায় ২৫০ টাকা। এদিকে বাগানের ব্যবহৃত রোগবালাই দমনে ঔষধ, সার ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে, কিন্তু নিলামমূল্য তারচেয়েও বেশি মাত্রায় কমেছে। চায়ের এই নিলামমূল্য দিয়ে লাভের প্রশ্নই ওঠে না, উৎপাদন খরচ বহন করাই কোনোভাবে সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সিলেটের কানাইঘাট লোভাছড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইউসুফ ওসমান বলেন, ‘উৎপাদনের সঙ্গে বাজারজাত বা বিক্রয়ের বিষয়টা জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশের চায়ের বড় রপ্তানি বাজার ছিল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। এই বাজারটি এখন নানা কারণে বাংলাদেশ হারিয়েছে। এর বদলে নতুন কোনো বাজারও সৃষ্টি হয়নি।’
এদিকে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি দাবি উঠেছে। সেগুলো হলোÑ কেজি প্রতি চায়ের নিম্নতম মূল্য ৩৫০-৪০০ টাকা নির্ধারণ করা, ভালো মানের চা নিলামে বিডিংয়ের মাধ্যমে বেশি দর পেতে পারে, দেশের বাইরে থেকে চোরাই পথে চা আসা বন্ধ করতে হবে, পঞ্চগড় এলাকায় চা উৎপাদনের মান এবং আইন ও বিধিসম্মতভাবে চা বাজারজাত করার বা হবে, ছোট কোম্পানি/বাগানকে প্যাকেজিংয়ের জন্য আর্থিক সাহায্য/সহায়তা দিতে হবে যাতে কল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে, প্যাকেজিংয়ের নিম্নতম পরিমাণ বর্তমানে ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ করতে হবে, ভালো প্যাকেটজাত চা বা টি-ব্যাগ রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, চা-বাগানকে বহুমুখী আয়ের উৎস সৃষ্টিকল্পে চা পর্যটন স্থাপনের সুযোগ দিতে হবে, কৃষি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের হার কমাতে হবে ও শর্তাবলি সহজ করতে হবে। রুগ্ণ, ছোট বা যেসব ছোট বাগানের উৎপাদন কম সেসব বাগানকে ৫ বছরের জন্য ট্যান্ড তাদের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ দিতে হবে।
এ ছাড়া ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্যাক্টরিতে সবুজ কাঁচা চা পাতা (যা পচনশীল) প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে, চায়ের মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। চা ফ্যাক্টরিগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান নোমান হায়দার বলেন, ‘উৎপাদন গণ্য নয়, সরকারের নির্ধারিত নিলামে ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চা আমাদের জাতীয় উৎপাদনে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও ওখানে চা উৎপাদনের কোনো নিয়মনীতি না মেনে নিম্নমানের চা উৎপাদিত হচ্ছে। ফ্যাক্টরি থেকে কোনো ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ না করে অবৈধভাবে চা বিক্রি হচ্ছে। এই নিম্নমানের চা বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানসম্মত চায়ের নিলাম বাজারে যথাযথ মূল্য পাওয়া থেকে বাধার সৃষ্টি করছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ চা বোর্ডের গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা ড. পীযুষ দত্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চা শিল্পের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এরপর কীভাবে এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’