রাজশাহী
শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:৫৩ পিএম
চারঘাট-বাঘার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে ৪২টি শৌচাগার নির্মাণ করা হয়। শৌচাগারগুলো গত দুই বছরে এক দিনও ব্যবহার করা যায়নি। প্রবা ফটো
৮০ বছরের বৃদ্ধা মাজেদা বেওয়া। গত বৃহস্পতিবার চারঘাট উপজেলার ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেছিলেন পেটের সমস্যাজনিত কারণে। ক্লিনিকের ভেতরে প্রবেশ না করতেই টয়লেটের চাপ আসে তার। কিন্তু ক্লিনিকে নতুন শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী না থাকায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিজ বাড়িতে ফেরত নিয়ে যায় স্বজনরা। এতে সেবা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় মাজেদা বেগমকে।
সেবাগ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার কারণে রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে এভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সেবাগ্রহীতারা। সরকারি ক্লিনিকে সেবা নিতে না গিয়ে গ্রামীণ ওষুধের দোকানে চিকিৎসা নিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এই দুই উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকে কোটি টাকা খরচ করে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণকাজে ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে শৌচাগারগুলো ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় নির্মাণের পরে এক দিনও ব্যবহার হয়নি। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে কমিউনিটি ক্লিনিকমুখী করার সরকারি উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা দুই উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই উপজেলার ৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিকে শৌচাগার (ওয়াশব্লক) নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। প্রতিটি শৌচাগারে ব্যয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি শৌচাগারে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক দুটি টয়লেট, ওয়াশরুম ও একটি হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন করা হয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ২০২২ সালে শৌচাগারগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ সালে (চারঘাট-বাঘা) সংসদীয় আসনে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের বরাদ্দের পুরো টাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের শৌচাগার নির্মাণে ব্যয় করা হয়। মূলত টাকাগুলো খরচ করার জন্য তড়িঘড়ি করে লোক দেখানো এ প্রকল্প নেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন কিংবা সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই না করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শৌচাগার নির্মাণের সময়ও ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ববানদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। এতে সবগুলো শৌচাগারই অকেজো হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে এ দুই উপজেলার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা গেছে, সবগুলো কমিউনিটি ক্লিনিকের শৌচাগারে তালা ঝুলছে, অধিকাংশ তালায় মরিচা ধরেছে। নির্মাণের দুই বছর অতিবাহিত হলেও অনেক ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ এখনও তা বুঝে পায়নি। যারা বুঝে পেয়েছে তারাও তা ব্যবহার করতে পারছে না। কোনোটাতে পানির ব্যবস্থা নেই, আবার কোনোটাতে পানির ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রথম এক সপ্তাহে নষ্ট হয়ে গেছে। কোনোটাতে পানি থাকলেও পানির লাইন ও শৌচাগারের প্যান ত্রুটিপূর্ণভাবে স্থাপন করায় তা ব্যবহার উপযোগী নেই। পূর্বে স্থাপনকৃত অগভীর নলকূপের পানির ট্যাংক থেকে শৌচাগারগুলোয় পানির লাইন দেওয়া হয়েছে। এভাবে সবগুলো শৌচাগারই ব্যবহারের আগেই অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।
চারঘাট উপজেলার ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আকতার বানু বলেন, দুই-আড়াই বছর আগে ক্লিনিকের শৌচাগার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তারপর থেকে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে, চাবিটাও দিয়ে যায়নি। এজন্য এক দিনও ব্যবহার করা হয়নি। শৌচাগারের প্যান, পানির লাইন, টাইলস সবই নিম্নমানের স্থাপন করা হয়েছে। রোগীরা এসে কষ্ট পায়, কিন্তু নতুন শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারে না।
বাঘার আড়পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের ফিরোজা খাতুন বলেন, শৌচাগার নির্মাণ করে দিয়েছে, কিন্তু পানির ব্যবস্থা নেই। এজন্য নির্মাণের পর থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ক্লিনিকের ভেতরে একটা টয়লেট আছে সেটা আমরা ব্যবহার করি, কিন্তু রোগীদের টয়লেটে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য মাঝে মাঝেই রোগীদের নিয়ে খুবই খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চারঘাট উপজেলা সহসভাপতি আঞ্জুমনোয়ারা ময়না বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যারা সেবা গ্রহণ করে তাদের অধিকাংশই নারী। মাতৃসেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা ও ওষুধ গ্রহণ করে তারা। অথচ এখানে শৌচাগার নির্মাণের নামে প্রকল্প নিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। নির্মাণের সময় আমরা মতামত দিলেও তা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সবগুলোর কাজ করা যেত। লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোটি টাকা পানিতে ফেলা হয়েছে।
চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তৌফিক রেজা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতা ও তাদের স্বজনদের জন্য শৌচাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শৌচাগার নির্মাণ হলেও সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আগামী সভায় বিষয়টি নিয়ে সিএইচসিপিদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চারঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফরহাদ লতিফ ও বাঘা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কী সমস্যার কারণে শৌচাগার ব্যবহার করা যাচ্ছে নাÑ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানালে সেগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।