জুয়েল সাহা বিকাশ, ভোলা
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:০০ এএম
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৮ এএম
প্রবা ফটো
নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্রদের পুনর্বাসনের আর্থিক সহযোগিতার টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নাম থাকা হতদরিদ্র ক্ষতিগ্রস্তদের ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই পেয়েছে ১০ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত অস্বচ্ছল হতদরিদ্রদের তালিকায় নাম রয়েছে উপজেলা ও ইউনিয়নের স্বচ্ছল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ ইউপি সদস্যদের। ঘটনাটি ভোলার মনপুরা উপজেলায়। হতদরিদ্র পরিবারের অভিযোগÑ তাদের নামে সরকারি টাকা লুটপাট করেছেন উপজেলার চার ইউপির চেয়ারম্যান। এর সঙ্গে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাও (পিআইও) জড়িত বলে অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার হাজিরহাট, মনপুরা, উত্তর সাকুচিয়ার ও দক্ষিণ সাকুচিয়ার ইউনিয়নের নদীভাঙন-কবলিত ১৫২ জনের পুনর্বাসনের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রী পুনর্বাসন সহায়তার আওতায় প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই টাকা তিন ক্যাটাগরিতে তালিকায় নাম থাকা পরিবারের মাঝে ৫০ হাজার, ৬০ হাজার ও ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে হাজিরহাট ইউনিয়নের ৫১ জন, মনপুরায় ৩৫ জন, উত্তর সাকুচিয়ার ৩৩ ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৩৩ জনের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়।
হাজিরহাট ও মনপুরা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র পরিবার সব প্রক্রিয়া শেষ করে টাকা উত্তোলন করলেও তাদের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ১০ হাজার টাকা করে। আর উত্তর সাকুচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়ায় জুটেছে সর্বোচ্চ ৩০-৪৫ হাজার টাকা করে।
হাজিরহাট ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকার আব্দুর রব জানান, নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য টাকা দেওয়া হবে বলে তার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার ছবি, ভোটার আইডি কার্ডসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যান। পরে সকল কাজ শেষ করে তার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ সকল প্রক্রিয়াই ইউপি চেয়ারম্যানরা দাঁড়িয়ে থেকে শেষ করেন। পরে ২০২২ সালের এপ্রিল ও মে মাসের দিকে ইউপি চেয়ারম্যানরা তাদের উপজেলার পিআইও অফিসে ডেকে আনেন। পরে পিআইও বরাদ্দের চেক বুঝিয়ে পাওয়ার খাতায় স্বাক্ষর ও টিপসই রেখে চেক হাতে দিয়ে ছবি তুল রাখেন। এ ছাড়া ১০-১২ জনের হাতে চেক দিয়ে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা চেয়ারম্যান, পিআইও সামনে নিয়েও ছবি তুলে রাখেন। ব্যাংকে ডেকে এনে চেক হাতে তুলে দিয়ে তাদের হাতেই টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যানরা। এরপর ২-৩ দিন পরে তাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডেকে পাঠান। সেখানে গিয়ে দেখেন তার মতো আরও কয়েকজন টাকা নিতে এসেছেন। পরে চেয়ারম্যান তাকেসহ কয়েকজনকে ১০ হাজার টাকা করে দেন। তখন ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি বলে দাবি তার।
একই এলাকার মো. সাহাবুদ্দিন জানান, পুনর্বাসনের সরকারি টাকা দেবে বলে তাদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেন। পরে চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পিআইও অফিসে নিয়ে স্বাক্ষর নেন। তার হাতে চেক তুলে দিয়ে ছবিও তোলেন তারা। ছবি তোলা শেষে চেয়ারম্যান তার হাত থেকে চেক নিয়ে যান। ব্যাংকে নিয়ে তাকে দিয়ে চেক জমা দিয়ে চেয়ারম্যান টাকা নিয়ে যান এবং পরের দিন তাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে দেখা করতে বলেন। চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলে তার হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন।
হতদরিদ্র কোহিনূর বেগম জানান, চেয়ারম্যানরা তাদের ৩০ হাজার টাকা কম দিয়েছেন। টাকার অভাবে জমি কিনতে পারেন না, মেয়ের বিয়েও দিতে পারেন না। তিনি কম দেওয়া ৩০ হাজার টাকা ফেরত চান। এজন্য তিনি সরকারের সহযোগিতা চান।
মনপুরা ইউনিয়নের সীতাকুণ্ড গ্রামের পুষ্পিতা রাণী ও হাজিরহাট ইউনিয়নের হাজিরহাট বাজারসংলগ্ন বেড়িবাঁধের বাসিন্দা নারগিজ বেগম, মো. দুলাল ও হেলাল জানান, তারা প্রকৃত নদীভাঙনের বসতঘরহারা। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত তারা।কিন্তু নদীভাঙনের পুনর্বাসনের আর্থিক সহযোগিতার তালিকায় তাদের নাম নেই। অথচ বড়লোক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের নাম ওই তালিকায় আছে।
অস্বচ্ছল না হয়েও পুনর্বাসনের টাকা পাওয়া মনপুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মনপুরা ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান রুহুল আমিন ও ইউনিয়নের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুয়েল চন্দ্র দাসের বাড়িতে গিয়ে পাকা বাড়ি দেখা গেছে। অনেক জমিজমা রয়েছে বলেও জানায় স্থানীয়রা। রুহুল আমিনের স্ত্রী জোসনা বেগম ও জুয়েল চন্দ্র দাসের মা পুষ্প রাণীর কাছে স্বচ্ছল হয়েও কেন পুনর্বাসনের টাকা নিয়েছেন জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাদের দাবি, ৫০-৬০ বছর আগে তাদের জমি নদীতে ভেঙে গেছে। রুহুল আমিন ও জুয়েল চন্দ্র দাসের কথা জানতে চাইলে ‘ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন’ বলে জানান।
এদিকে ৫ আগস্টের পর গা ঢাকা দিয়েছেন অভিযুক্ত হাজিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, মনপুরার চেয়াম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমানউল্যাহ আলমগীর, উত্তর সাকুচিয়ার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও দক্ষিণ সাকুচিয়ার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অলিউল্যাহ কাজল।
মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানউল্যাহ আলমগীর পুনর্বাসনের টাকা লুটপাটের কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে জানান, তালিকায় থাকা ১৫২ জনের বরাদ্দ থেকে পিআইও ইলিয়াস মিয়া ১৫ ভাগ কমিশন নিয়েছেন। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য অনেক কৌশলও করেছেন। পিআইও তালিকার নাম যাচাই-বাছাই করেছেন। তিনি দুর্নীতি করে এখন চেয়ারম্যানদের ফাঁসাচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
কিন্তু অভিযোগ মানতে নারাজ উপজেলার সাবেক পিআইও ইলিয়াস মিয়া। তিনি জানান, তালিকা করা, যাচাই-বাছাই সবই ইউপি চেয়ারম্যানরা করেছেন। তারাই তালিকায় তাদের স্বচ্ছল দলীয় নেতা ও ইউপি সদস্যদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। তিনি কোনো অনিয়ম করেননি ও কোনো কমিশনও নেননি। বর্তমান পিআইও ফজলুল হক জানান, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। কেউ লিখিত অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দেন।
ইউএনও পাঠান মো. সাইদুজ্জামান জানান, পুনর্বাসনের টাকা বিতরণের অনিয়মের বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানাবেন। লিখিতভাবে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেবেন।