প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:৫৬ এএম
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৩:২৪ এএম
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক তরফা নির্বাচনে ঋণখেলাপিদের প্রার্থী হওয়ার গুরুতর অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের যোগসাজশে অন্তত ৬০০ জন এমপি (সংসদ সদস্য) প্রার্থী ঋণখেলাপি থাকা সত্ত্বেও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ছাড়পত্র পেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশে খেলাপিদের ছাড়পত্র দিতেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদ।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিতর্কিত শিল্প গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে তাদের তদবিরে একই বিভাগের ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন মুন্সি ওয়াকিদ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তিনি বহাল আছেন। এখনও বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। আতিফ আসলাম নামের একজন ব্যক্তি নির্বাচন কমিশন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে অভিযোগপত্রটি পাঠিয়েছেন।
মুন্সি ওয়াকিদের মতোই বহাল তবিয়তে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক দেব দুলাল রায়। এমপি প্রার্থীদের সিআইবি ছাড়পত্র দেওয়ার মুখ্য দায়িত্ব মুন্সি ওয়াকিদের হাতে থাকলেও চূড়ান্ত অনুমোদন দিতেন দেব দুলাল রায়।
প্রসঙ্গত, দেশের সব ঋণগ্রহীতার তথ্য সংরক্ষিত হয় সিআইবিতে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ। ঋণ তথ্যের গোয়েন্দা বিভাগও বলা হয় একে। ব্যাংকিং খাতের ঋণশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই বিভাগ ভূমিকা রাখে।
অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পর্শকাতর বিভাগ সিআইবির পরিচালক মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৬০০ জন ঋণখেলাপি এমপি প্রার্থীকে সিআইবি ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত
চার দিন মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। ওই চার দিনে ৩ হাজার ৩৬২ জন নৌকার পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তাই মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদের মাধ্যমে ছাড়পত্র নিয়েছেন অন্তত ৬০০ জন সংসদ সদস্য প্রার্থী। তিনি এসব ব্যক্তিকে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সিআইবিতে ঋণের তথ্য হালনাগাদের নিয়মে পরিবর্তন আনার নির্দেশ দেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদের পরামর্শে গভর্নরের নির্দেশনা অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণের তথ্য সরাসরি সিআইবির ড্যাশবোর্ডে আপলোড করার ক্ষমতা পায়। তবে সবশেষ অনুমোদন রাখা হয় সিআইবির হাতে। সেই সুযোগে সরকারের মদদপুষ্ট অনেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে সিআইবি রিপোর্টে পরিবর্তন করেছেন। আর তাদের খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখাতে তৎপর ছিলেন মুন্সি ওয়াকিদ।
এদিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও পদ ছেড়ে এখনও পলাতক। অথচ সিআইবিতে গত ২৩ বছর স্বপদে বহাল রয়েছেন মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহচর। বিতর্কিত এ কর্মকর্তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব প্রদান এবং বর্তমানেও স্বপদে বহাল রাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই কর্মকর্তাকে দ্রুত সিআইবি থেকে প্রত্যাহার এবং শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগপত্রে আরও লেখা হয়, ফ্যাসিস্ট শাসক আওয়ামী লীগের এমপি প্রার্থীদের ঋণ তথ্য পর্যবেক্ষণে শিথিলতা দেখানো এবং তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে গভর্নরের সুনজরে আসেন। হয়ে উঠেন আরও অপ্রতিরোধ্য। সিআইবি রিপোর্টের মাধ্যমে পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপকে বহু সুবিধা দিয়েছেন। ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার রাস্তা তৈরি করে মুন্সি ওয়াকিদ নিজেও সুবিধাভোগী হন।
গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগে শেখ হাসিনা রেজিমের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিবর্তন এলেও মুন্সি ওয়াকিদ অজানা শক্তির জোরে সিআইবি বিভাগে বহাল রয়েছেন; যা দেশের অর্থনৈতিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদের মোবাইলে অনেকবার কল করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছেন অভিযোগ হাতে পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক দেব দুলাল রায় অবৈধভাবে তার বিভাগের কর্তৃত্ববহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও সিআইবির ক্ষমতা হাতে রাখছেন। সিআইবিকে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিলাষে দেব দুলাল সিআইবি-সফটওয়্যারে সব কন্ট্রোল নিয়ে কর্মকর্তাদের কর্মহীন করে রেখেছেন। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ তথ্য আপডেট করার ও সিস্টেমে তা নয়-ছয় করার সুযোগ দিয়ে এর কন্ট্রোল দেব দুলালের হাতে নিয়েছেন।
সম্প্রতি ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটির কাছে দেওয়া এক চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, দেব দুলাল ও আটক হওয়া প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক একই স্কুলের ছাত্র। সেই সুবাদে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পলক, দেব দুলাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে আইটি বিভাগে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং সেক্টরের আইসিটি খাত নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ক্রয় কাজে এই সিন্ডিকেট কাজ করে। এ ছাড়াও শেখ হাসিনার ছেলে জয়, দেব দুলাল ও মেজবাউল হক মিলে পেমেন্ট সিস্টেমস এবং আইসিটি বিভাগের সব ক্রয়সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন আইসিটি পণ্যের উৎপাদক, ডিস্ট্রিবিউটর ও সরবরাহকারী মিলে এক অবিচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট করে ১ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রথমত বিগত নির্বাচনটি ছিল দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের একটি পাতানো খেলা। এই খেলায় অংশ নিতে যারা প্রতারণার মাধ্যমে বেআইনি কাজে যুক্ত হয়েছেন তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা বেআইনি সুবিধা দিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’
উল্লেখ, খেলাপি গ্রাহকরা যেন নতুন ঋণ না পায়, সেজন্য যেকোনো ঋণ প্রদানের আগে ব্যাংকাররা সিআইবি রিপোর্ট পর্যালোচনা করেন। সিআইবি দেশের ঋণখেলাপিদের নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক এবং নিয়োগের ক্লিয়ারেন্স দেয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং জাতীয় নির্বাচনের সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নমিনেশনের ক্লিয়ারেন্স এই বিভাগ থেকেই দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি, পিবিআই ও ডিবির মতো সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য সিআইবি থেকে সংগ্রহ করে। এই ক্লিয়ারেন্সের ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়Ñ কোন ব্যক্তি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), পরিচালক হতে পারবেন কি না, সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না বা বিডা থেকে বিনিয়োগ পেতে পারবেন কি না।